সিলেটMonday , 22 August 2022
  1. আইন-আদালত
  2. আন্তর্জাতিক
  3. উপ সম্পাদকীয়
  4. খেলা
  5. ছবি কথা বলে
  6. জাতীয়
  7. ধর্ম
  8. প্রবাস
  9. বিচিত্র সংবাদ
  10. বিনোদন
  11. বিয়ানী বাজার সংবাদ
  12. বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন
  13. ব্রেকিং নিউজ
  14. মতামত
  15. রাজনীতি

অভিবাসনের সুখ-বিড়ম্বনা (পর্ব-১৫)

Link Copied!


আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
প্রতিকূল প্রকৃতি, চাকরির বাজারের নানা রকম চ্যালেঞ্জ, সমাজ সংস্কৃতির বৈপরিত্য, ভাষার ভিন্নতা, চলাচলের জন্য গণপরিবহণের ওপর নির্ভরতা, জীবন-জীবিকা নিয়ে উৎকন্ঠা, যথাযথ তথ্যের ঘাটতি- সবকিছু মিলিয়ে অধিকাংশ নতুন অভিবাসীদের জীবনেই উদ্বেগের সীমা থাকে না। অনেক শুভ সংবাদও তখন উৎকন্ঠাকে বাড়িয়ে দেয়। শীতকালে গণপরিবহণের ওপর নির্ভরতায় জীবন বেজায় কষ্টকর হয়ে উঠে। যে দেশে অভিবাসীদের প্রতি মিনিট সময় অর্থ মূল্যে নির্ধারিত হয়, সে দেশে ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া চলাচলের উপায় কোথায়? হুট করে প্রশিক্ষকের কাছে গিয়ে, কিছুদিন প্র্যাকটিস করে গাড়ি কিনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব, সে সুযোগও নেই। নানা ধাপ অতিক্রম করে লাইসেন্স পেয়ে, গাড়ি চালক হতে হবে, এসব ভেবে মনে নানা শঙ্কা কাজ করে।

দেশ থেকে আসার আগে অফিসের গাড়িচালক সাজ্জাদের চাপাচাপিতে একটি লাইসেন্স নিয়ে এসেছিলাম। সুদর্শন, স্মার্ট সাজ্জাদ দেশ বিদেশের এতো খবর রাখেন, তা আগে জানা ছিলো না। অফিস থেকে বিদায় হওয়ার আগে, স্মার্ট কার্ডের আদলে তৈরি আমার সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য সংবলিত একটি ড্রাইভার লাইসেন্স আর সেই সাথে একটি কাগজ দিয়ে বলেছিলেন, ‘বস, নিয়ে যান, কাজে লাগবে’। অবশ্য এগুলো পেতে সহকারী মুশতাক আর সাজ্জাদকে বিআরটিএ যে দান-দক্ষিণা ছাড়া বিদায় দেয়নি, সেটি সহজে অনুমেয় হলেও আমাকে বুঝতে না দেয়ার মধ্যেই যেন সেদিন তাদের তৃপ্তি ছিল। মনে মনে বিষয়টিকে গুরুত্বহীন ভাবলেও, শুধু সৌজন্যতার খাতিরেই সেদিন তাদের কে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। কে জানতো সময়ের পরিক্রমায়, প্রবাস জীবনে দুই সহকর্মীর পীড়াপীড়িতে প্রাপ্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের লাইসেন্সটি আমার অভিবাসী জীবনে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে!

কানাডার প্রতিটি প্রদেশেই ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আলাদা আলাদা নীতিমালা আছে। তবে যে কোন প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত লাইসেন্স দিয়ে পুরো উত্তর আমেরিকার যে কোন জায়গায় গাড়ি চালানো যায়। এদেশে গাড়ি চালানোর রোড টেস্ট দিতে হলে প্রত্যেক প্রার্থীকেই আগে ড্রাইভিং এর নীতিমালা সম্পর্কিত নলেজ টেস্ট বা লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। ভুল উত্তরের জন্য সঠিক উত্তরের নম্বর কেটে নেয়ার নিয়ম সম্বলিত পরীক্ষাটি বেশ কৌশলী। তাই নিয়ম কানুনের যথাযথ জ্ঞান অর্জিত হলেই পরীক্ষায় অংশ নেয়া সমীচীন। যতবার ইচ্ছা পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ থাকলেও, যেহেতু পরীক্ষার ফি টি বেশ ব্যয়বহুল আর নিয়ম কানুনের যথাযথ অনুসরণ ব্যতীত গাড়ি চালানো মানে জীবনকে ঝুঁকি পূর্ণ করে তোলা, তাই পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।

নলেজ টেস্টের এই পরীক্ষাটিতে কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয়, তাই অনেকে এটিকে কম্পিউটার টেস্টও বলে থাকেন। পাশ করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি লার্নাস কিংবা প্রশিক্ষণার্থী লাইসেন্স ইস্যু করেন। আলবার্টা প্রদেশে এই লাইসেন্সটি ক্লাস-সেভেন হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের লাইসেন্সধারী কোন ব্যক্তির একক ভাবে গাড়ি চালানোর সুযোগ নেই। জিডিএল ক্লাস ফাইভ বা তদূর্ধ্ব মানের লাইসেন্স আছে এমন ব্যক্তিকে পাশে নিয়ে ক্লাস সেভেন লাইসেন্স বহনকারী ব্যক্তি প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। তবে চূড়ান্ত রোড টেস্টের জন্য কমপক্ষে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। শর্ত আছে, কোন ব্যক্তির যদি অন্য কোন দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে এবং সেই দেশটি যদি আলবার্টা সরকারের রেজিষ্ট্রেশন অথরিটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকে তাহলে দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষা না করে, সংশ্লিষ্ট দেশের লাইসেন্সটি সারেন্ডার করে তাৎক্ষণিক রোড টেস্টে অংশ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে যাচাই-বাছাইয়ে যদি ইস্যুকৃত লাইসেন্সটির যথার্থতা প্রমাণিত না হয়, তবে ক্রিমিনাল অফেন্সের কারণে জেল-জরিমানা ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।

আগস্ট ২০০৬ সালের কোনো এক সকালে আলবার্টা রেজিস্ট্রির সানরিজ শাখায় গিয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেই। নিয়ম নীতি নিয়ে কয়েক দিনের পড়াশুনা বেশ কাজে লাগে। নরটেলে আমার সহকর্মী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাইফের সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি বেশ সহায়ক হয়। সেই সাথে বড্ড আনন্দের বিষয় ছিলো, বাংলাদেশের বিআরটিএ কর্তৃক ইস্যুকৃত লাইসেন্সটি যাচাই-বাছাই শেষে রেজিষ্ট্রেশন অথরিটির কাছে গৃহীত হয়েছে। তাই আমাকে রোড টেস্ট দেয়ার জন্য দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। গাড়ি চালনায় কনফিডেন্স থাকলে, যে কোন দিন ক্লাস ফাইভ লাইসেন্সের জন্য রোড টেস্টে অংশ নিতে পারবো। ২০০০ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় অলৌকিক ভাবে বেঁচে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে গাড়ির স্টিয়ারিং আমার কাছে যেনো মারণাস্ত্রের মতো লাগে। তবুও এক বছর অপেক্ষা করার শর্তে আবদ্ধ না হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় সাবেক সহকর্মী সাজ্জাদ আর মুশতাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় হৃদয়টা ভরে যায়।

দশ ঘণ্টার প্যাকেজ লার্নিংয়ের পরেও ড্রাইভিংয়ে কোনো কনফিডেন্স আসেনি। চায়নিজ ইন্সট্রাক্টরকে অনুরোধ করে আরও চার ঘন্টার বাড়তি প্রশিক্ষণ নিলাম। তবুও প্রথম বারের পরীক্ষা মানে রোড টেস্টে অকৃতকার্য হলাম। পরের বার পাশ করলেও কি করে একা একা গাড়ি চালাবো, এটি ভেবে মাথায় যেন বাজ পড়ে গেল। শীতকাল সমাগত, তার আগেই জড়তা কাটিয়ে ড্রাইভার হতেই হবে। নানা ভয় আর শংকা মাথায় নিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলাম। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ, অনেকটা বাংলাদেশের বসন্ত কালের মতো। দিনে প্রখর রৌদ্রময় আলোকোজ্জ্বল আবহাওয়া আর রাতে বাসন্তী বায়ু অনুভব করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। সাজ সকালে ঘুম থেকে উঠে, তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, সবকিছুই ভারী শুভ্রতায় ঢেকে আছে। বাড়ি, গাড়ি, রাস্তা-ঘাট, সব যেন একাকার। এ দৃশ্য আমার কাছে নতুন। চারিদিক তাকিয়ে অনেকটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। উৎকন্ঠা নিয়ে পরিচিত একজনকে ফোন দিতেই বললেন- ‘বাহিরে গিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে এসো’। পরামর্শ মতো হাঁটতে গেলে, ভয়-শঙ্কার পরিবর্তে প্রকৃতির যে মায়াময় কোমল পরিবেশ অনুভব করেছিলাম, সেটি যেন সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার পরম ভালোবাসার এক জীবন্ত নিদর্শন।

পরিমিত তথ্যের অভাবে অভিবাসীদের জীবন মাঝে মাঝে বেশ সমস্যা সংকুল হয়ে উঠে, আর এটি যদি স্বাস্থ্য, চিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত কোন বিষয় হয়, উদ্বেগের মাত্রাটা মাঝে মাঝে সহনশীলতার সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। আমার স্ত্রী মা হতে চলেছেন। নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা আর মাসে মাসে ডাক্তারের ফলোআপ, এসব নিয়ে আমাদের চেয়ে যেনো ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা পারিবারিক চিকিৎসকের চিন্তাটাই বেশি। কখন কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কখন কিভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হবে, সব দায়িত্ব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানই নিচ্ছেন। যথা সময়ে যথাস্থানে হাজির হওয়াটাই যেন আমার মূল দায়িত্ব। ডাক্তারের চিকিৎসা, ডায়াগনস্টিক টেস্টসহ সকল পরীক্ষা নীরিক্ষার খরচ আলবার্টা সরকারের হেলথ ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমেই কাভার হচ্ছে, তবুও প্রসবকালীন হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ নিয়ে মাথায় কিছুটা দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।

সন্তানসম্ভবা নারীদের প্রতি কানাডিয়ান সমাজের দায়িত্ববোধ দেখে বিস্ময় ভরা শ্রদ্ধাবোধ যেন বেড়েই চলেছে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাসহ বাড়তি আনুকূল্য, পাবলিক ট্রানজিট, শপিং সেন্টার সহ যে কোন স্থানে অপেক্ষামান লাইনে সবাই তাদের বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সরকারি, বেসরকারি, প্রাইভেট নির্বিশেষে সকল চাকুরীজীবিই মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়ে থাকেন। সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত ছুটির পাশাপাশি বেতনের সর্বোচ্চ ৮০% কর্মবীমা সুবিধা পেয়ে থাকেন। চাইলে একবছরে ছুটিকালীন সময়টিকে পিতা-মাতা ভাগাভাগি করেও নিতে পারেন। অর্থাৎ মাতৃত্বকালীন এক বছর ছুটির সময়টিতে পিতৃত্বকালীন সুবিধা নেয়ারও সুযোগ আছে। এতসব ভালো কিছুর মাঝেও আমার স্ত্রীর সন্তান জন্মদানের সময়টি যতই ঘনিয়ে আসছে, উদ্বেগ উৎকন্ঠা যেন বেড়েই চলেছে। যে সমাজে নানি, দাদি, আত্মীয়-পরিজন সবাই মিলে প্রসূতি মা আর নবজাতকের সেবায় ব্যস্ত সময় কাটায়, সেই সমাজ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কানাডার প্রবাস জীবনে নবজাতকের দেখাশোনা, লালন-পালনের ব্যাপারগুলো ভাবতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই যেন চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।

নবজাতক সন্তানটি ছেলে না মেয়ে হবে, এ নিয়ে হবু পিতা-মাতা আর স্বজনদের আগ্রহের শেষ থাকে না। শুনতে বিদঘুটে লাগলেও এটিই বাস্তব- এ নিয়ে কোনোকালেই আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। প্রথম সন্তানের জন্মের পরই জেনেছিলাম, ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছি। যদিও পরে জেনেছি, আমি ছেলে সন্তানের বাবা হবো, সেটি নাকি আমার পরিবারের সবাই আগে থেকেই জানতেন। তবে এবারের বিষয়টি একেবারেই ব্যতিক্রম। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এক সপ্তাহ আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে হয়। এসব পরীক্ষা নীরিক্ষার পরে চিকিৎসক সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখ নির্ধারণ করেন। আলাপ আলোচনার ফাঁকে আগ্রহের আতিশয্যে আমার স্ত্রীর হবু সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে, সেটি জানতে চাইলে চিকিৎসক বিষয়টি এড়িয়ে যান। যে দেশে চিকিৎসকরা সেবাগ্রহীতাকে তার স্বাস্থ্যগত প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপন করেন, সেই দেশে আমার হবু সন্তানের লিঙ্গ পরিচিতি নিয়ে ডাক্তারদের গোপনীয়তা উদ্বেগের মাত্রাটিকে বাড়িয়ে দেয়। বিষয়টি নিয়ে আমার স্ত্রী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের সঙ্গে কথা বললে, চিন্তাক্লিষ্ট চেহারার অস্পষ্ট উত্তরে উৎকণ্ঠার ব্যারোমিটারটি যেন উদ্বেগে ভারি হয়ে উঠে!!

লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার