স্টাফ রিপোর্টার:
আগস্ট। বাঙালি জাতীয় জীবনে অত্যন্ত বেদনাবিদুর, অশ্রু ঝরানো, শোকাবহ মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতি হারিয়েছে তার অমূল্য রতন। বাংলার জনপদে নিরলস ছুটে চলায় যিনি বাঙালি জাতিসত্তাকে মুক্তির মোহনায় উপনীত করেছিলেন, জীবনের শ্রেষ্ট সময়টুকু বাঙালির অধিকার আদায়ের কথা বলতে গিয়ে কারান্তরীণ হয়ে কাটিয়েছিলেন, যার তর্জনী হেলনে নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামী ও গেরিলা যোদ্ধা হয়ে ওঠেছিল, এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালির কপালে কালিমা লেপন করে স্বার্থলোভী ও চাকরিচ্যুত কতিপয় সেনা কর্মকর্তা। তাদের পিছনে কলকাঠি নেড়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল। সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুই আস্তে আস্তে জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপর খন্দকার মোশতাক স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও মেজয় জিয়া সেনাপ্রধানের দায়িত্বে এসে তাদের কলুষযুক্ত চেহারা উন্মোচন করে।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান এ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে।
দীর্ঘ ২১ বছর নানা ছলছাতুরি, হামলা, মামলা ও নির্যাতন করে আওয়ামী লীগকে জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা করে, ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। শত ঝড়, ঝঞ্ঝা বুকে নিয়ে, রোদ, বৃষ্টি গায়ে মেখে, লাঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাসকে মোকাবেলা করে দীর্ঘ সংগ্রামে পথ বেয়ে জাতির পিতার কন্যা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের অবরুদ্ধ পথ অবমুক্ত করতে সক্ষম হন। এবং স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়ায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে বঙ্গবন্ধু ও তার সপরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের রায় ঘোষিত হয়। ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে এ বিচার প্রক্রিয়া আবারো বাধাগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যার ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতি তার পিতা হত্যার কলঙ্ক হতে মুক্ত হলেও জাতির জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সম্ভাবনার দীর্ঘ সময়টুকু।
১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাস। সেদিনের কিছু স্মৃতিকথা আজ আমি নতুন প্রজন্মের জন্য এখানে তুলে ধরতে চাই।
‘বাংলাদেশ জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ এর ব্যানারে চট্টগ্রামে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। স্থানীয় মুসলিম হলে ১৭ আগস্ট হতে ১৯ আগস্ট তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন হবে ঠিক হলো। তপন বৈদ্য ছিলেন এ সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক আর আমি ছিলাম যুগ্ম আহ্বায়ক। ভারত ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের অনেকেরই এ সম্মেলনে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনি ভাই এ ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন। কথা ছিল, সম্মেলনের প্রত্যেকদিন একটি করে তিনদিনে মোট তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। আর, নাটক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। জাতীয় সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার উন্নয়নে জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ছিলেন অন্ত:প্রাণ। আমাদের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবে আমরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব শেখ কামাল সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় আমরা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ মান্নান ভাইয়ের বাসায় যাই, তার সাথে আমাদের সম্মেলন প্রস্তুতির নানাদিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। তিনি আমাদেরকে সম্মেলনের খরচের জন্য ৫০০০ টাকা দেন এবং রাতের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এরপর আমরা তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ.বি. চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাদেরকে পরদিন সকালে তার বাসায় যেতে বলেন।
সর্বশেষে আমরা তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার চট্টগ্রাম প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই।কাশেম চিশ্তী সাহেবও সেদিন আমাদের সাথে ছিলেন। নুরুল ইসলাম সাহেবের বাসার ল্যান্ড ফোন থেকে আমরা সম্মেলনের উদ্বোধক বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ১৭ তারিখে আমাদের সম্মেলনে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করার ব্যাপারে আমাদেরকে শতভাগ আশ্বাস প্রদান করেন। নুরুল ইসলাম সাহেবের নন্দনকানস্থ বাসা থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছাই যখন, তখন রাত ১টা। বেশকিছু কুকুর একসাথে কান্নার রোল তুলে ডাকছিল। মনটা কেমন যেন মোচর দিয়ে উঠল, কেমন যেন বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল শরীর মন। তাছাড়া মুরব্বিদের মুখে শুনেছি, কুকুরের কান্না নাকি অশুভ লক্ষণ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তপন বৈদ্য বলল দেশে কোথায় কোন অঘটন ঘটতে চলেছে কে জানে? কুকুরগুলো এভাবে কান্না করছে কেন? আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ওসব কিছুই না। এগুলো সব মুরব্বিদের বলা কুসংস্কার। তারপর আমরা ঘুমোতে যাই। সকালে ওঠে ডিসি সাহেবের বাসায় যাব এমন সময় লেয়াকত নামের জাসদ সমর্থক এক ছাত্র আমাকে জানাল বঙ্গবন্ধুকে নাকি ভোরবেলায় হত্যা করা হয়েছে। আরেকটু পর আরেক ছাত্রনেতা গোলাম মোহাম্মদও একই কথা বলল। আমি তাদের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্যারেড কর্নারের পূর্বপাশে খালেকের বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠালাম। বললাম, তোমাদের রেডিওটা অন কর। রেডিও অন করতেই খুনিদের ঘোষণা শুনতে পেলাম। তবুও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এসব কিছু স্বাধীনতা বিরোধীদের অপপ্রচার।
আমরা দ্রুত মতিন বিল্ডিংয়ের ছাত্রলীগের অফিসে গেলাম। সেখানে ছাত্রলীগ নেতা সরফরাজ খান বাবুল, সন্দ্বীপের রফিকুল ইসলাম, ফটিকছড়ির আনোয়ারুল আজিম, শওকত হোসেন, মান্নান, ইসমাইল, কাশেম চিশ্তী, পটিয়ার এম এ জাফর, শামসুজ্জামানসহ বিশ-পঁচিশজন ছাত্রনেতাকে একসাথে পেলাম। তৎক্ষণাৎ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কে.সি দে রোড, টিএন্ডটি অফিস, লালদীঘি হয়ে রেয়াজউদ্দীন বাজার আমতল, তিনপুলের মাথা হতে ঘুরে শহীদ মিনার হয়ে পুনারায় পার্টি অফিসে আসি। কোথাও কোন বাধা পাইনি। রাস্তায় তেমন কোনো মানুষজন কিংবা পুলিশও ছিল না। সবদিকে কেমন জানি সুনসান নীরবতা। তপন বৈদ্যর বাসা ছিল ফকির হাট। মিছিলের পর আমরা তার বাসায় যাওয়ার পথে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনের সামনে নামলাম এবং স্টেশনে ঢুকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বক্তব্য রাখার সুযোগ চাইলাম। রেডিও কর্তৃপক্ষ রাজি হলেন না। তারপর তপন বৈদ্যর বাসায় চলে যাই। বাকশাল সাধারণ সম্পাদকের সাথে জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য নেতাদের প্রায় সকলেই ঢাকায় ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ঢাকার সাথে সারাদেশের সমস্ত যোগাযোগ মূলত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিকেলে আমরা আবারো বেরিয়ে পড়ি। মুক্তিযোদ্ধা চেঙ্গিস খানের শ্বশুরের কাজীর দেউড়ির বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কয়জন কথা বলছিলাম। বিকাল পাঁচটার দিকে দেখলাম সামরিক বাহিনীর কিছু গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে পথচারীদের হুমকি, ধমকি দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করছে। আমরা রাস্তার পাশ ছেড়ে কিছুটা ভেতরে গলির দিকে ঢুকে পড়লাম। আমাদের মধ্যে কাশেম চিশতীর বাসা ছিল চাক্তাই। আমরা সবাই যে যার বাসায় চলে গেলাম।
১৭ আগস্ট সকালে চট্টগ্রাম কলেজ হোস্টেল থেকে রাউজানের সালাম ও বাবুল আমাদের বহরদার বাড়ির বাসায় আসে পরবর্তী করনীয় বিষয়ে আলোচনা করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী ও কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথেও যোগাযোগ করতে লাগলাম।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এস এম ইউসুফ ভাই (মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর জেলা প্রধান) আমার বাসায় আসলেন। বললেন, চল বাইরে যাব। মাকে বলে বেরিয়ে পড়লাম (মা অবশ্য বাধা দিয়েছিলেন, তবুও) দুজনে। ইউসুফ ভাই আমাকে জামালখানের নজরুলের বাসায় রেখে কোথায় জানি চলে গেলেন। সেই রাতে নজরুলের বাসায় রয়ে গেলাম। সকালে সাতকানিয়ার মুনিরের মারফত ইউসুফ ভাই খবর পাঠালেন। বললেন, তিনি আসবেন। সারাদিন অপেক্ষায় ছিলাম, রাত দশটার দিকে আবারো মনির এসে আমাকে তার সাথে বের হতে বললেন। বললেন, ইউসুফ ভাই আমাদের জন্য অভয় মিত্র ঘাটে অপেক্ষা করছেন। অভয় মিত্র ঘাটের একটি ফিশিং বোটে আনোয়ারুল আজিম, গোলাম রাব্বানী, মো. সেলিম, শওকত হোসেন, রফিক, মনির, কাজী আবু তৈয়ব, মহিউদ্দিন রাশেদ, শামসুজ্জামান, জাফর, দেলোয়ার, মান্নানসহ আমরা ১৪জন ইউসুফ ভাইয়ের সাথে বসলাম। ইউসুফ ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে করনীয় সম্পর্কে আমাদের উদ্দেশ্যে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখেন এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এ বৈঠকের ঠিক পনের দিন পর আমরা নিউ মার্কেট মোড়, আগ্রাবাদ, কাজীর দেউরীসহ চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি জায়গায় গ্রেনেড চার্জ করি। এরপর ইউসুফ ভাইসহ কাজী আবু তৈয়ব ও আমি আমাদের নেতা মান্নান ভাইয়ের বাসায় যাই। শক্তি সংগ্রহের জন্য ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে মান্নান ভাইকে বুঝিয়ে বলি। মান্নান ভাই এতে রাজী হলেন না। কিন্তু ইউসুফ ভাই ঠিকই ভারতে চলে গেলেন। এদিকে কঠোর বিধি নিষেধের যাঁতাকলে পড়ে কোথাও জড়ো হওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ল। তখন নিউমার্কেটে নজরুলের শাহ আমান স্টোর হয়ে উঠল আমাদের যোগাযোগের অন্যতম ক্ষেত্র। এখানে আমরা ক্রেতাবেশে আসতাম এবং পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণ করব। ছাপানোর দায়িত্ব ছিল ফটিকছড়ির এস এম ফারুকের উপর। যথারীতি লিফলেট ছাপানো হলো, বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হলো। এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে আমরা প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকলাম। নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ আমরা জানতে পারলাম, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে কারাগারের ভেতর ঢুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন মুক্তি যোদ্ধা নুরুল বশর ও আমি আমাদের বহরদার বাড়ির বাসা থেকে বেরিয়ে কাজেম আলী স্কুলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে লিয়াকত (পরবর্তীতে কমিশনার) ও আওয়ামী লীগ কর্মী ফোরক আহমদের সাথে দেখা হয়। ৪ জন মিলে আলাপ করলাম কি করা যায়! লিয়াকত বলল, চল আমরা চট্টগ্রাম কলেজ গিয়ে প্রতিবাদী মিছিল বের করি। যদিও আমি সভাপতি নির্বাচিত হই ১৯৭২ সালে, সম্মেলন না হওয়ায় তখনো আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে আছি। আমরা কয়েকজন দ্রুত কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লাম আর গ্যালারি ২ তে গিয়ে বললাম ক্লাস হবেনা। শিক্ষক আবু তাহের সাহেব তা মানতে রাজী হলেন না। লিয়াকত ক্যাম্পাসের এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে, একজন ছাত্র ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে আয়নায় সজোরে একটি পাথর ছুড়ে মারল। বিকট আওয়াজ আর কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ শুনে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা দিগ্বিদিক ছুটতে আরম্ভ করল। তারপর, প্রতিবাদী ছাত্রদের নিয়ে আমরা মিছিল বের করি এবং মহসীন কলেজ, কাজেম আলী স্কুল ও খাস্তগীর স্কুলের ক্লাশ বন্ধ করে দিই।
এরপর মিছিল নিয়ে আন্দরকিল্লা, নজির আহমদ সড়ক, রাইফেল ক্লাব হয়ে শহিদ মিনারের দিকে ঘুরতেই নিউমার্কেটের ঐদিক থেকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর কয়েকটি গাড়ী এসে আমাদের উপর হামলে পড়ে। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তৎকালীন গ্র্যান্ড হোটেলের গলিতে ঢুকে যাওয়ার পরও দেখি পুলিশ আমার পিছু ছাড়েনি। পাশ্ববর্তী একটি ভবনের সীমানা প্রাচীর টপকে আমি কোন প্রকারে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলেও অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। রাঙ্গুনিয়ার এমপি মরহুম ক্যাপ্টেন কাশেম সাহেবের একান্ত সহাযোগিতায় পরের দিনই তারা ছাড়া পান। সেদিন বিকেলেই ইউনাইটেড হোটেলের সামনে সিটি কলেজের ছাত্রনেতা জানে আলমের সাথে আমাদের দেখা হয়। হোটেলের কাছেই জানে আলমের বাসা। হোটেল মালিকের শ্যালক যখন বললেন, কক্সবাজারের গোলাম রাব্বান ভাই হোটেলে আছেন তখন আমরা হোটেলের এক কোনার গোপন আস্তানায় তার সাথে দেখা করলাম। তিনি বললেন, আমরা সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের করব তোমরা দ্রুত প্রস্তুতি নাও।
চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে এসেবেয়ারা বশরকে ৫০ টাকা দিয়ে বাঁশ, চট ও কেরোসিন আনতে পাঠালাম। কিছু পরে হোস্টেলের আরেক বেয়ারা চিত্ত এসে বলল মশালের সরঞ্জামসহ বশর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আমাদের মশাল মিছিলের পরিকল্পনা এখানে ব্যর্থ হলো। এরপর রাব্বান ভাইসহ আমরা পরেরদিন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফেনীর গোলাম মোস্তফার সাথে যোগাযোগ করলাম। তার একটা ছাপখানা ছিল, এখান থেকে হরতালের সমর্থনে লিফলেট ছাপানো হলো। সারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঐ লিফলেট বিতরণ করা হলো। মুত্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল বশর ও আমি বহরদার হাট, মুরাদপুর, চকবাজার, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও এলাকার দায়িত্ব নিয়ে লিফলেট বিতরণ করি। হরতাল হয়নি, পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে ছিল না সেটাতো বুঝতেই পারছেন। আমরা বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি দিয়ে সরকার ও প্রশাসনকে আস্তে আস্তে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছিলাম মাত্র। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, মহানগরীর বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে প্রতিবাদী কর্মসূচি দিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাই। সেদিনের কথা মনে হলে হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। রাতারাতি সবকিছু যেন বদলে গিয়েছিল তখন। চেনা মানুষগুলোর অনেকেই যেন অচেনা হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু থাকাকালীন সময়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা লোকগুলো, যাদের সাথে আমাদেরও বেশ সখ্যতা ছিল, আজ তার রঙ বদলে নিয়েছে গিরগিটির মতো। তাদের কাছে গেলে তারা আমাদের দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে লাগল। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানান কটুক্তি করতেও ছাড়েনি তারা। তাদের এই কটু আচরন, স্বৈরাচার ও স্বাধীনতা বিরুধী অপশক্তি এবং সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারী গোষ্ঠীর অত্যাচার, নিপীড়ন, প্রলোভনকে পদদলিত করে জীবনবাজি রেখে আমরা মুজিবপ্রেমী জনগণ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে ন্যাস্ত করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু, বর্ণচোরা গিরগিটির দল আবারো আওয়ামী লীগ ও রাষ্ট্র ক্ষমতার নানান স্তরে জেঁকে বসেছে। নিজেদের প্রভাব বলয়ের বিস্তার ঘটাতে প্রগতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে অবস্থানকারী স্বাধীনতা বিরোধীদেরও মুজিবাদর্শের সৈনিক আখ্যা দিয়ে প্রকৃত মুজিপ্রেমীদের কোণঠাসা করে রাখার অপপ্রয়াসে লিপ্ত।
তারা আজ ভাবতে শুরু করেছে সংগঠনে তারাই শক্তিশালী। তাই তারা অসম্ভব রকমের বেপরোয়া। এদের আস্ফালন ও বেপরোয়া আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগের অনুসারীরা রাজনীতি কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তাদের অভিমানী মন আজ রাজনীতিবিমুখ। এর থেকে ফায়দা লুটছে সুবিধাবাদীরা, তারা ক্ষমতার সুযোগে দিনের পর দিন অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হচ্ছে। আর এই অর্থের দাপটে আদর্শিক কর্মীরা আজ ক্ষত-বিক্ষত।
তাই শোকের মাসে ডাক দিয়ে যাই- আসুন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা। আর হতাশা নয়, অভিমান নয়। সুবিধাবাদীদের হটিয়ে, তাদের সব চক্রান্তকে পদদলিত করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঝাণ্ডা উড়াই। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাছে আমরা ঋণী। আমরা দায়বদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক, ইতিহাসের শ্রেষ্ট সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণের কাছে। আসুন জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অভিযাত্রাকে কন্টকমুক্ত করতে ও জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী রাখতে কাজ করে যাই।
সবাইকে ধন্যবাদ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু জননেত্রী শেখ হাসিনা।