সিলেটSaturday , 10 September 2022
  1. আইন-আদালত
  2. আন্তর্জাতিক
  3. উপ সম্পাদকীয়
  4. খেলা
  5. ছবি কথা বলে
  6. জাতীয়
  7. ধর্ম
  8. প্রবাস
  9. বিচিত্র সংবাদ
  10. বিনোদন
  11. বিয়ানী বাজার সংবাদ
  12. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
  13. ব্রেকিং নিউজ
  14. মতামত
  15. রাজনীতি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও এক কালো রাত

Link Copied!

আতাউর রহমান:

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট। এটি বাঙালি জাতির একটি বেদনাবিধূর শোকের দিন। এদিনে বুলেটের আঘাতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কিন্তু ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধুর দেহ নিস্তেজ করলেও বাঙালির পরিচয়ে, মানসপটে, মানচিত্রে, পতাকায়, অস্থিমজ্জায় যিনি মিশে আছেন, তাঁকে কিভাবে মেরে ফেলা যায়! পারে নাই, কোনদিন পারবেও না।

বিবিসি’র জনমত জরিপে নির্বাচিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রায় বলতেন: বাঙলা ও বাঙালির জন্য আমার জীবনের তিনটি লক্ষ্য আছে :
          এক. বাংলাদেশকে স্বাধীন করা।
          দুই. মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়া ও 
          তিন. বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের স্বপক্ষে লড়াই করা।

তৃতীয় বিশ্বের সুযোগ্য নেতৃত্ব ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, মিসরের নাসের এবং ভারতের পণ্ডিত নেহরুর মৃত্যু পরবর্তী তৃতীয় বিশ্ব নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। তখনই শূন্য নেতৃত্বের যুগসন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব ঘটে। বলা যায়, অনেকটা শান্তির দূতরূপে। শুধু বাঙালিদের জন্য নয়; আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার নির্যাতিত মানুষের জন্যে। কারণ তিনি পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করতেন। এই সংকল্প নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠির কব্জা থেকে তাঁর প্রথম লক্ষ্যটি অর্জন করলেন, তখনই তাঁকে জুলিওকুরি শান্তি পদকে (১৯৭৪ সালে) ভূষিত করা হলো। অতঃপর তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন। তাঁর এই গতিবেগ আর সহ্য হলো না সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের দোসরদের। পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফাঁদ তৈরি হলো। শেষ পর্যন্ত সেই ষড়যন্ত্র ফাঁদই কাল হয়ে দাঁড়ালো বাঙালিদের অর্থনৈতিক স্বস্তির সংকল্পের-মিনারে। দূর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। বঙ্গবন্ধুর বাকী দুটি লক্ষ্য আর পূর্ণ হলো না। পূর্ণতা লাভের আগেই বাঙালি জাতির সামনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর একটি কালো রাত হানা দিল। মহান নায়কের প্রস্থান হলো। এই কালো রাতটি কিভাবে বাঙালিদের জীবনে এসেছিল, তারই বর্ণনা এই নিবন্ধের বিষয়।

এক.
লেঃ কর্ণেল ফারুক রহমান ও লেঃ কর্ণেল আব্দুর রশীদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন,—–
“প্রকৃতপক্ষে আগস্ট বিপ্লবের সংগঠকরা ১৯৭৩ সালের শেষদিক থেকেই পরিস্থিতির উপর তীব্র নজর রেখে আসছিলেন। তাঁরা গোটা পরিস্থিতি নিরীক্ষা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম নির্ধারণ করার ব্যাপারে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে একটি যৌক্তিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে বিস্তারিত কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয় এবং একটি খসড়া সময়সূচীও নির্ধারণ করা হয়। গোপনীয়তা রক্ষা করার স্বার্থেই বিস্তারিত কার্যক্রমের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রায় ৬ মাস কেটে যায়। কেননা এটি বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহের কার্যকরণের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চূড়ান্ত আঘাত হানার দুটি নির্ধারিত সময়সূচী ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, দুটি বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিপ্লবের মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ১৫ আগস্ট ছিল চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সর্বশেষ সময়সূচী। ১২ আগষ্টের মধ্যে আমাদের কাছে এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ১৫ আগস্ট হচ্ছে চুড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মোক্ষম সময়। চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ১২ আগস্ট ও ১৪ আগস্ট এর মধ্যবর্তী সময়কে বেছে নেয়া হয়। পরিকল্পনা কার্যকরী করার আদেশ প্রদান করা হয় ১৫ আগস্ট এবং ঐ দিনই সূর্যাস্তের পর থেকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। উপরোক্ত বিস্তৃত ব্যাখ্যা থেকে এটা খুব সহজেই বোঝা যায় যে, ১৫ই আগস্টের পদক্ষেপ আকস্মিক বা হটকারী সিদ্ধান্তের ফল নয়। দ্বিতীয়তঃ এটা স্বীকার করতে দোষ নেই যে, আমরা অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ ছিলাম সত্য।”
–(মুক্তির পথঃ কর্ণেল রশিদ-ফারুক লিখিত পুস্তকের সাক্ষাৎকার অংশ থেকে গৃহীত।)

দুই.
ফারুকের পুরো নাম দেওয়ান এশারেত উল্লাহ সৈয়দ ফারুক রহমান। মোশতাক আহমদ এর সম্মতিতে জানা যায়, ফারুকের পকেট ডায়রিতে লাল কালিতে মোটা অক্ষরে লিখা ছিল…কাজ শুরু। তারিখঃ ৩জুলাই ১৯৭৫।

সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন হিসেবে সুলতানের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আবুধাবিতে গমন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের সংস্থাপন বিভাগের সচিব নুরুল কাদের খান ছিলেন ফারুকের চাচা। তার-ই চিঠি পেয়ে ফারুক রহমান ১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর আবুধাবী হতে লন্ডনের পথে যাত্রা করে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে ফারুক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার পূর্বেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ফলে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসারগণ প্রমোশন পেয়ে পদন্নোতি হলেও ফারুকের ভাগ্যে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রমোশন জুটেনি। এই সেই ফারুক, যার পকেট ডায়েরীতে উল্লেখ ছিল যে, 
            “মুজিবকে মারতে হবে। তিন জুলাই থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমার অতীত বর্তমান আমি মুছে ফেলেছি। আমার সামনে তখন একটি লক্ষ্য, মুজিবকে খতম করতে হবে। ১৫ আগস্টে রাতে বেঙ্গল ল্যান্সার এবং সেকেণ্ড ফিল্ড আর্টিলারীর পরবর্তী ট্রেনিং অনুষ্ঠিত হবে। দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিনটিই ফারুকের কাছে ছিল উপযুক্ত সময়।”

শুক্রবার দিনটি কর্ণেল ফারুক রহমানের জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, তাঁর জন্ম হয়েছিল শুক্রবারে। তাঁর জীবনের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে শুক্রবারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে যেদিন তিনি পালিয়ে যান, সেদিন ছিল শুক্রবার। তিনি বিয়ে করেছিলেন শুক্রবারে। ধর্মীয় কারণেও শুক্রবার খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তাই তিনি মনে করতেন, ১৫ অগস্টের শুক্রবারও তাঁর জন্য শুভ হবে।

এদিকে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে সরাবার প্রক্রিয়ায় মেজর রশিদ ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব ও সহযোগিতা লাভের আশায় তার সাথে সাক্ষাৎ করলে জেনারেল জিয়া বললেন, 
              “আমি একজন সিনিয়র অফিসার। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমি জড়িত হতে পারি না। কিন্তু তোমরা, জুনিয়ার অফিসাররা আগ্রহী হলে এগিয়ে যেতে পারো।” সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান একজন জেনারেলের কাছে প্রেসিডেন্ট সরানোর ষড়যন্ত্র শোনা মাত্র যেখানে অধীনস্থ সৈনিক গ্রেফতার হওয়ার কথা, সেখানে ঘাতকচক্র অপারেশন চালাতে আর নিরুৎসাহিত হলো না। এমনকি জেনারেল জিয়া বিষয়টি প্রেসিডেন্টকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না।

তিন.
মার্চ, ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে বলা হলঃ সেনাবাহিনীকে বসিয়ে রাখা সঠিক নয়। সেজন্য নির্দেশ গেল ঃ ট্রেনিং কোর্স চালু কর। বিশেষতঃ ট্রেনিং প্রয়োজন পুনর্গঠিত ট্যাংক বাহিনীর ও গোলন্দাজ বাহিনীর অর্থাৎ সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারী এবং বেঙ্গল ল্যান্সারের। কিন্তু তাদের নিকট ট্রেনিং বড় কথা ছিল না। তাদের মনে ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র।

চার.
সেজন্য তারা ১৯৭৫ সনের মার্চ মাস থেকেই একত্রে ট্রেনিং শুরু করে। সেই সাথে তারা এ নির্দেশ ও অনুমতি লাতেও সক্ষম হয় যে, অন্যান্য ট্রেনিং ব্যতিরেকেও প্রতিমাসে তারা দুবার নাইট ট্রেনিং করতে পারবে। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। এমনি এক ট্রেনিং। ট্রেনিং-এ ট্যাংক রেজিমেন্ট ও বেঙ্গল ল্যান্সার এর সাথে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারীর সমন্বয় সাধন করা হয়। এসব বাহিনীতে সর্বসাকুল্যে ৪শ’ জন সেনাশক্তি ছিল। আর ছিল ৩০টি ট্যাংক, ১৮টি কামান। এর মধ্যে দুটি ট্যাংক ছিল নষ্ট এবং অকেজো। কামানের ক্যাটাগরী ছিল ১০৫ এম.এম যুগোশ্লাভের তৈরী হাউটজার।

পাঁচ.
ষড়যন্ত্র চলছিল অন্যভাবেও। সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারী ব্যাটেলিয়ানের কমাণ্ডিং অফিসার তখন লেঃ কর্ণেল আনোয়ার হোসেন। আর ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার বাহিনীর অর্থাৎ ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন লেঃ কর্ণেল আব্দুল মোমেন। কিন্তু ১৪ আগস্ট রাতে নাইট ট্রেনিং এ যাবার সময় দেখা গেল লেঃ কর্ণেল আনোয়ার হোসেন পূর্বেই প্রেসিডেন্ট এর স্পেশাল মিলিটারী সেলের ডেপুটেশনে সেখানে কর্মরত আছেন। আরো দেখা গেল, বেঙ্গল ল্যান্সার বা ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল আবদুল মোমেন ছুটিতে বাহিরে আছেন। সুতরাং সেকেণ্ড ফিল্ড আর্টিলারীর কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব অর্পিত ছিল মেজর রশিদের উপর এবং বেঙ্গল ল্যান্সার বা ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব ন্যস্ত হল মেজর ফারুক রহমানের উপর। সেনাবাহিনীর কোন উর্ধ্বতন  অফিসারের ষড়যন্ত্রে এরূপ সুবর্ণ দায়িত্ব মেজর রশিদ-ফারুকের হাতে গিয়ে পড়েছিল তা আজও রহস্যাবৃত। সুতরাং ট্যাংক বাহিনী ও আর্টিলারী রেজিমেন্টের দায়িত্ব পেয়ে দুই ভায়রা ফারুক ও রশীদ পরিকল্পনা মাফিক বর্তমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সৈন্য সামন্ত ও কামান সহ গমন করে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পূর্বে তারা সেনাবাহিনী হতে বহিষ্কৃত কতিপয় অফিসারকে যাদের শেখ মুজিবুর রহমানের উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল, তাদেরকে আসার জন্য সংবাদ প্রেরণ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র একঘণ্টা পূর্বে প্রাক্তন অফিসারবৃন্দ তাদের সাথে যোগ দেয়।

 ১৫ আগস্ট ভোর ৪:৪০ মিনিট থেকে ৫:০০ টার মধ্যে উপস্থিত সেনাশক্তিকে তিনভাগে বিভক্ত করা হল। ল্যান্সার গারেজে দাঁড়িয়ে আছে ২৮টি ট্যাংক, ১২টি ট্রাক, ৩টি জীপ এবং ১০৫ মিঃ মিঃ হাউটজার সহ ৪০০ সৈন্য। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শুরু হল। ১২টি ট্রাকে কালো ইউনিফর্ম পরিহিত যমদূতের দল। রাতের চাঁদ তখন ডুবে গেছে। ট্যাংক গর্জন করে উঠলো। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা রক্ষীবাহিনী। ঢাকায় তখন তিন হাজার রক্ষীবাহিনী মোতায়েন ছিল। কর্ণেল ফারুক রক্ষীবাহিনীকে নিউট্রালাইজ করার দায়িত্ব নিল। ৭৫ থেকে ১৫০ জনের বড় দল তিনটিকে প্রধান তিন টার্গেট শেখ মুজিব, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মণির বাসার দায়িত্ব দেয়া হল। চূড়ান্ত হল : মেজর ডালিম এর দায়িত্ব সেরনিয়াবাতকে হত্যা। শেখ মুজিবকে উৎখাতের দায়িত্ব নিয়ে প্রাক্তন মেজর নূর ও মেজর মহিউদ্দিন এক কোম্পানী ল্যান্সারসহ রওয়ানা হলেন এবং ফারুকের আস্থাভাজন নন-কমিশনড অফিসার রিসালদার মোসলেমের দায়িত্ব ছিল শেখ মণিকে হত্যা করা। কর্ণেল শাহরিয়ার সহ অন্যরা রেডিও দখলের দায়িত্ব নিল।

কর্ণেল ফারুক জানতেন, ঢাকায় অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর হাতে তখন ভারী কোন অস্ত্র ছিল না। ট্যাংক বিধংসী কোন অস্ত্র নেই; যা আছে সবই হালকা অস্ত্র । ফারুক ২৮টি ট্যাংক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট গ্যারেজ হতে বের হন। কিন্তু তেজগাঁও বিমান বন্দরের নিকট এসে তিনি দেখলেন যে, তাকে একটি মাত্র ট্যাংকই অনুসরণ করতে সমর্থ হয়েছে। এতে তিনি ভীত হলেন না। তিনি যখন রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের নিকটে চলে গেলেন তখন দেখলেন যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত ও হেলমেট পরিহিত অবস্থায় রক্ষীবাহিনীর একটি ব্রিগেড লাইন আপ হয়ে আছে। কিন্তু তারা কোন প্রকার রিয়েক্ট করলো না। ওরা দূরে গোলাগোলি শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। তার উপর ওদের সামনে ট্যাংক দেখে ওরা এক চুল নড়লো না। তখন ফারুক নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, আর কোন ঝামেলা হবে না। কাজেই রক্ষীবাহিনীকে পাহারা দেবার জন্য একটি ট্যাংক রেখে অন্যটি নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে রওয়ানা হলেন। এদিকে ফারুক রহমানের সাথে যে ট্যাংকগুলো ছিল, তাতে গোলাবারুদ ছিল না। কারণ, ট্যাংকগুলোর সমস্ত গোলাবারুদ জয়দেবপুরের অর্ডান্যান্স ডিপোতে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। এটা জেনেও তিনি এগুলোকে মনস্তাত্বিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। আর সেজন্য কর্ণেল রশিদ বাহিনীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত অন্যান্য অস্ত্র, কামান গ্রহণ করেছিলেন। রশিদকে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবের বাসার দিকে গোলা বারুদ নিক্ষেপ করতে যাতে রক্ষীবাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যাতে তারা শেখ মুজিবের সাহায্যে অগ্রসর হতে না পারে।

ছয়.
এই মোক্ষম সময়কে সামনে রেখেই সি.আই.এ. রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিফেন্স সম্পর্কিত একটি কোর্সে প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এই আমন্ত্রণ পেয়েই তিনি ১২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে লন্ডনে জানলেন বঙ্গবন্ধু নিহত। তখম রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে লেঃ কর্ণেল আবুল হাসান। ভীতস্থ ও আতঙ্কগ্রস্থ একজন পাকিস্তান ফেরত অফিসার পলাতক।  ফলে রক্ষীবাহিনীকে অর্ডার দেয়ার কর্তৃত্ব কারো ছিল না। তখন  দীপক তালুকদার রক্ষীবাহিনীর সিনিয়র লিভার। তিনি ছিলেন সেদিনের ডিউটি অফিসার। পরদিন বঙ্গবন্ধু মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। খুব ভোরে দীপক তালুকদার গাড়ী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ব্যবস্থাদি দেখতে গেলেন। কামানের আওয়াজ শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়া যাচ্ছে না। প্রচণ্ড গুলাগুলি চলছে। তখন গাড়ী ঘুরিয়ে তারা সদর দপ্তরের দিকে রওনা হয়।

সাত.
কর্ণেল ফারুক যখন রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পসাইড হতে ধানমন্ডীর দিকে রওয়ানা হলেন তখন ধানমন্ডীর ৩২ নম্বরের অবস্থা গোলযোগপূর্ণ। রশীদের গোলন্দাজ বাহিনীর লোক এগিয়ে আসে দ্রুততার সাথে। মেজর মহিউদ্দিন ও মেজর (অবঃ) নুর আর হুদার নেতৃত্বে প্রধান ঘাতক দলটি ভোর সোয়া পাঁচটায় শেখ মুজিবের বাড়িতে পৌছে গেছে। তারা প্রথমেই বাধা পায় প্রেসিডেন্টের গার্ডদের তরফ থেকে। মেজর মহিউদ্দিন গাড়ি হতে নেমে আসে। গার্ডদের পথ ছেড়ে দেবার আদেশ করলে ল্যান্সার বাহিনীর লোকেরা তাদের স্যালুট করে পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। গার্ডদের মধ্যে অল্প সংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য থাকলেও তারা নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পরিকল্পিতভাবে পূর্বেই ফারুক রহমান এদেরকে বিগ্রেডিয়ার মশারুল হককে (তিনি মোনায়েম খানের মিলিটারী সেক্রেটারী ছিলেন) দিয়ে প্রেসিডেন্টের পাহারায় নিযুক্ত করেছিল। ফলে প্রেসিডেন্টের গার্ডবাহিনী আর বাধা প্রদান করেনি। বাধা প্রদান করে একজন পুলিশ ডি.এস.পি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এরপর সেনাবাহিনীরা বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং চারিদিক হতে গুলাগুলি করতে থাকে।

গুলির আওয়াজ শোনে মুজিব প্রথমেই ফোন করলেন রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে। তিনি কোন সিনিয়র অফিসার পেলেন না। পরে তিনি ফোন করলেন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ও তাঁর সামরিক সচিব বিগ্রেডিয়ার মাশহুরুল হককে। তাঁদেরকে অবিলম্বে সাহায্য পাঠাতে নির্দেশ দিলেন। অবশেষে তিনি ফোন করলেন, মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের কর্ণেল জামিলকে। জামিল দ্রুত সাড়া দিলেন। কিন্তু ৩২ নম্বরে ঢুকার আগেই তাকে আটকানো হল। এদিকে দরজা খোলাই ছিল। মহিউদ্দিন, হুদা, নূর কতিপয় সৈন্য নিয়ে উপরে উঠতে থাকে। তখন মুজিবের দু’ ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল তাদের ষ্টেইনগান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আততায়ীদের ঠেকালেন। তারপর কামাল নিহত হলেন। এ সময় কর্ণেল জামিল বাধাদানকারী সৈনদের পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু তখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন। তাঁর পরনে ছিল চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবী ও স্যান্ডো গেঞ্জি। বুক পকেটে ছিল চশমা। কাদের উপর ছিল দুই আড়াই হাতের তোয়ালে। হাতে ছিল পাইপ। কিন্তু কামালকে মেরে ফেলা হয়েছে শুনে তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন ও সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। তখনই প্রত্যাশিতভাবে মহিউদ্দিন তাঁকে দেখতে পান মাত্র ২০ ফুট দূরে মুজিব সিঁড়ির উপর পড়িয়ে আছেন। 

মুজিবকে দেখামাত্র হত্যা করার নির্দেশ থাকা সত্বেও মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে দেখেই তার মনোবল হারিয়ে ফেলেন। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, স্যার, আপনি আসুন। মুজিব গর্জে উঠলেন, “কি চাও তোমরা তোমরা কি আমাকে খুন করতে এসেছো? ভুলে যাও। পাকিস্তানী আর্মিরা এটা পারে নাই। তোমরা কি মনে করো, তোমরা পারবে?” মহিউদ্দিন তখনও বারবার বলছিলেন, স্যার আপনি আসুন আর মুজিব তাঁকে কড়া ভাষায় ধমকাচ্ছিলেন। ফারুক রহমান এসময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, মুজিৰ সময় কাটাতে চাইছেন। যতদূর জানা যায়, ততক্ষণে উপস্থিত হলেন সুবেদার মোসলেম উদ্দিন। মোসলেম শেখ মণিকে খুন করে এখানে প্রবেশ করেছে। এসেই মহিউদ্দিন ও বঙ্গবন্ধুর এ অবস্থা দেখে মহিউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়েই সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। গুলির ধাক্কায় বঙ্গবন্ধুর দেহ কিছুটা পিছিয়ে গেল। তারপর তিনি পড়ে যান সিঁড়ির উপর। বঙ্গবন্ধুর শরীরে ১৮টি গুলি লাগে। তখনো তাঁর হাতে পাইপটি শক্ত করে ধরা ছিলো। তখন ভোর ৫:৪০ মিনিট। পড়ে যাওয়া পুরো দেহটার উপর চলে ব্রাশ ফায়ার। তারপর মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়ে চলতে থাকে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। দু’ কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যতিত সপরিবাৱে সবাই সেদিন নিহত হন।

আট.
বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন সকালে যে সকল অফিসার প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করেছেন তারা হলেন মেজর (অবঃ) ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর বজলুল হুদা, মেজর রশীদ চৌধুরী, মেজর মহিদউদ্দিন, মেজর নূর, মেজর শরীফুল হোসাইন, ক্যাপ্টেন কিসমত হোসেন, লেঃ খায়রুজ্জামান ও লেঃ আব্দুল মজিদ। এদিকে ফারুক ও রশিদ ১৯৮৩ সালে স্যাটারডে পোষ্টে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন,
 “আমরা কোন সামরিক অভ্যুত্থানের সংগঠক কিংবা নেতা নই। আমরা দু’জনই ১৫ আগস্ট অপরাহ্নে আমাদের কমাণ্ড রেজিমেন্টের কাজে হস্তান্তর করি এবং ঐদিন একজন বেসামরিক প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করেন। এরপর আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছি।”

নয়.
আসলে ভাগ্যই সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আগষ্টের ১০ তারিখ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাগ্নীর বিয়ে। এই বিয়ে উপলক্ষে সবাই ঢাকায় সমবেত হয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেরনিয়াবাত-এর ছেলে খুলনা থেকে কিছু বন্ধুও সঙ্গে এনেছিলেন। তারাও তখন ঢাকায় অবস্থান করছিল। আর ১৪ আগস্ট ছিল সেরনিয়াবাতের মায়ের চেহলাম। ফারুক ও রশীদ যখন এই পরিবারের উপর আঘাত হানে তখন তারা সবাই শেখ মুজিবের ধানমন্ডীর বাড়ির অর্ধ বর্গমাইল এলাকার মধ্যেই অবস্থান করছিলেন। যার ফলে ঘাতকদের নির্ধারিত ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের কালো রাত্রিতে তাঁদের অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁদের নামের তালিকা নিম্নরূপ :

  • জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
  • বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব
  • আবদুর রব সেরনিয়াবাত
  • শেখ ফজলুল হক মণি
  • শেখ আবু নাসের
  • বেগম শামসুন্নেসা মণি
  • শেখ কামাল
  • শেখ জামাল
  • শেখ রাসেল (বঙ্গবন্ধুর ৮ বছরের কনিষ্ঠ পুত্র)
  • বেগম সুলতানা কামাল
  • বেগম রোজী জামাল
  • শহীদ সেরনিয়াবাত ( আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভ্রাতুষ্পুত্র)
  • বেবী সেরনিয়াবাত (বয়স ১৪ বছর)।
  • আরিফ সেরনিয়াবাত (বয়স ১২ বছর)। 
  • বাবু সেরনিয়াবাত (বয়স ৫ বছর)। 
  • নান্টু (সেরনিয়াবাতের ভাগ্নে)।

কর্ণেল জামিল (বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কর্তব্যরত ডি.এস.পি)। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ীর কয়েকজন কর্মচারী।

গুলিতে আহত:

  • বেগম আবদুর রব সেরনিয়াবাত
  • বেগম আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ্ (আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্রবধু)
  • বিউটি সেরনিয়াবাত (কন্যা)
  • আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (ভ্রাতুপুত্র) 
  • হেনা সেরনিয়াবাত (কন্যা)।

লেখক পরিচিতি:
মাস্টার ট্রেইনার ও কলামিস্ট, পঞ্চখণ্ডের পথ ও পথিকৃৎ গ্রন্থের লেখক,   প্রাক্তন সভাপতিঃ বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।