স্টাফ রিপোর্টার:
অপরাধ আর অভিযোগের যেন অন্ত নেই পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণির সদস্যের বিরুদ্ধে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক (পরকীয়া), মদ্যপান, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে নির্যাতন, অন্যায়ভাবে সাধারণ মানুষকে তুলে নিয়ে নির্যাতন কিংবা নিয়মিত ঘুষ নেওয়াসহ নানা গুরুতর অপরাধের অভিযোগ এখন শোনা যাচ্ছে অহরহ।
এমনকি ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা ধরনের ভয়ংকর ফৌজদারি অপরাধেও ব্যাপকহারে জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির পুলিশ সদস্য। ইতিমধ্যে এমন কয়েকটি মারাত্মক অপরাধের ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গ্রেফতারও হয়েছেন। বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীনও হয়েছেন বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। কিন্তু কেন? কেন অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে পুলিশে তা নিয়ে প্রশ্ন এখন জনমনে? পুলিশের মতো একটি গৌরবময় শৃঙ্খলাপূর্ণ বাহিনীতে অপরাধপ্রবণতা প্রতিনিয়ত কেন বাড়ছে তা নিয়ে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, গুরুতর অপরাধ করেও অনেক ক্ষেত্রে ‘একশ্রেণির প্রভাবশালী’ পুলিশ সদস্য পার পেয়ে যাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগীয় অভিযোগ রুজু হলেও অপরাধ প্রমাণের পর শাস্তি হিসেবে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের ‘লঘুদণ্ডের’ আওতায় দেওয়া হচ্ছে সাধারণ ‘তিরস্কার’ বা ভর্ৎসনা। যে শাস্তিকে অনেকেই ‘দায় এড়ানো’ বলেও মনে করেন। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে এক বছরের বেতন বৃদ্ধি স্থগিত কিংবা পদাবনতি করা হচ্ছে। ‘গুরুদণ্ডের’ আওতায় চাকরিচ্যুত করার ঘটনা হাতে গোনা মাত্র। এ কারণে এসব শাস্তিকে গায়ে লাগাচ্ছেন না অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যরা। ফলে পরে আরও বেপরোয়া হচ্ছেন তারা কিংবা অন্য পুলিশ সদস্যও অপরাধ-অপকর্মে জড়াতে উৎসাহী হচ্ছেন।
এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধে যারা জড়িয়েছেন বা শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন সেগুলো তেমন প্রকাশ পাচ্ছে না। যদিও পুলিশ সদর দফতর বলছে, যেকোনো পর্যায়ে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ পেলেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেটি দেখা হয়। সে কারণে বাহিনীতে শাস্তির উদাহরণও আছে অহরহ।
পুলিশ সদর দফতর থেকে জানানো হয়েছে, ২০১৭ থেকে চলতি ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে এক লাখ তিন হাজার ১৭০ পুলিশ সদস্যকে ‘লঘুদণ্ড’ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই সময়ে ‘গুরুদণ্ড’ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৮০০ জনকে।
‘বাংলাদেশ গেজেট’ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যদের অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। একটি হচ্ছে-‘লঘুদণ্ড’ এবং আরেকটি ‘গুরুদণ্ড’। এখানে লঘুদণ্ড বলতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩ বিধির কয়েকটি উপবিধি এবং ৪(ক)-এর কয়েকটি উপবিধি অনুসারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লঘুদণ্ড বা বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে-তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা, আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে বেতন বা আনুতোষিক হতে আদায় করা অথবা বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ। অন্যদিকে গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে, নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ এবং বরখাস্তকরণ।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুসারে, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে রুজুকৃত অভিযোগের সংখ্যা দুই হাজার ৯৭০টি, পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১৯০ এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৯ মাসেই রুজুকৃত অভিযোগের সংখ্যা হয়েছে দুই হাজার ৫৭৪টি। এর বাইরেও পুলিশ সদর দফতরে ‘আইজিপি’স কম্পেøইন সেলে’ সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষেরা বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে অভিযোগ করে থাকেন কিন্তু গত কয়েক বছরে বা চলতি বছরে কতজন পুলিশ সদস্য ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়েছেন সেই পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি পুলিশ সদর দফতর।
পুলিশ সদস্যদের অপরাধ ও শাস্তির প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘সরকারের এ বিষয়ে আইন আছে। সরকারের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড আপিল নামে একটা রুলস রয়েছে। এই রুলস অনুসারে কাকে কি ধরনের সাজা দেওয়া যাবে, কীভাবে দিতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে সেই আইনে বলা আছে। ওই আইনের বাইরে গিয়ে শাস্তি বেশিও দিতে পারবেন না, চাইলে কাউকে কমও দিতে পারবেন না। সেই আইনের মধ্যে থেকে সাজাগুলো দিতে হয় এবং সেটিই হচ্ছে।’
কিন্তু একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ বাহিনী হিসেবে এ শাস্তি কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ-এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘পুলিশও সরকারি ফোর্সের অংশ। সরকারের কর্মচারীর একটি অংশ। এখানে কনস্টেবল থেকে ওসি পর্যন্ত ‘পুলিশ আইনে’ সাজা দেওয়া হয় এবং এএসপি থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত ‘সরকারি আইনে’ সাজা দেওয়া হয়। সরকারি যে নিয়ম রয়েছে এবং পুলিশের যে নীতিমালা রয়েছে সেই অনুসারী সাজা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের কেউ অপরাধে জড়ালে ছাড় পাচ্ছে না।’
যদিও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, ফৌজদারি অপরাধ যারা করছেন তারা সাধারণত তেমন একটা শেল্টার পান না। গ্রেফতার হচ্ছেন এবং প্রচলিত আইনে বিচারের মুখোমুখিও হচ্ছেন কিন্তু অন্যান্য অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তির ক্ষেত্রে যথেষ্ট বৈষম্য রয়েছে। তাদের তথ্য মতে, যারা কঠোর বা বেশি শাস্তির মুখে পড়ছেন তারা অধিকাংশই নিম্ন পদের তথা কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পর্যায়ের পুলিশ সদস্য কিন্তু তাদের শেল্টারদাতা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বরাবরই থেকে যাচ্ছেন নিরাপদে। এমনকি যখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে গুরুতর অপরাধ করছেন তখন তারা তেমন কোনো কঠোর শাস্তির মুখে পড়ছেন না। খুব বেশি আলোচিত না হলে সামান্য ‘তিরস্কার’ বা সাময়িক বেতন বৃদ্ধি স্থগিতের মতো লঘুদণ্ডেই পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনাতেও দেখা যায়-সহকর্মীর স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া, মদ্যপান, জুয়া থেকে অর্থ আদায়, আওয়ামী লীগ নেতাকে বেআইনিভাবে আটক রেখে নির্যাতনসহ গুরুতর নানা অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও পুলিশের ঊর্ধ্বতন চার কর্মকর্তাকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধি অনুযায়ী শাস্তি হিসেবে মাত্র ‘তিরস্কার ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিত’ করা হয়েছে। অবশ্য এদের কেউ কেউ সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। গত ২৭ ও ৩০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এই পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
অভিযুক্ত ওই চার পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে পুলিশ সদর দফতরে (সাময়িক বরখাস্ত) সংযুক্ত অতিরিক্ত ডিআইজি (আগে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি) মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন চাকরিতে থাকা অবস্থায় তার অধীন সহকর্মীর স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক (পরকীয়া) গড়েন। নিজের যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে নির্যাতন এবং একপর্যায়ে তালাক দিতে বাধ্য করেন। অন্যজন গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) ডিসি মিজানুর রহমান দিনাজপুরে অতিরিক্ত পুলিশ থাকাকালে জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলে আগামী এক বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছে। আরেকজন হলেন ডিএমপির বর্তমান উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. সালাউদ্দিন শিকদার, যিনি ২০১১ সালে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সে সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে যশোর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বিপুকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে ১৫-১৬ ঘণ্টা অবৈধভাবে আটক রেখে শারীরিক নির্যাতন করেন।
প্রথমে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া লঘুদণ্ড প্রাপ্ত আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলেন বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (পুলিশ সুপার) কাজী মো. ফজলুল করিম। ২০০৮ সালের ২০ মার্চ মহাখালীতে ডিএমপির তৎকালীন পিএসআই অলিউল হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে বরখাস্ত) তার অন্যান্য সহযোগীসহ প্রাইভেটকারে রিপন নামে এক প্রবাসীর কাছ থেকে ৮৬ হাজার সৌদি রিয়াল, মোবাইল ফোন ও পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেননি তৎকালীন ডিএমপির দায়িত্বশীল ডিসি ফজলুল করিম। এ জন্য তাকেও ‘তিরস্কার’ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের অভিযোগ পেলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে পুলিশ সদর দফতর। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সেসব অভিযোগ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এএসপি (সহকারী পুলিশ সুপার) থেকে তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি, শাস্তি, বরখাস্তসহ সার্বিক বিষয় দেখভাল করে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া কনস্টেবল থেকে শুরু করে পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের ওইসব বিষয় দেখভালের দায়িত্ব পুলিশ সদর দফতরের।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিক সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)’ নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ‘পুলিশ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে অনাস্থা ও প্রশ্নের জায়গাগুলো বড় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত দৃশ্যত এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না যা থেকে আস্থা ফিরে আসবে। আমরা দেখছি, গুরুতর অপরাধেও লঘুশাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যা থেকে বাহিনী আজ সমাজে এমন কোনো শক্ত বার্তা যাচ্ছে না। ফলে আমরা পুলিশকে ছিনতাইকারী হতে দেখি, পুলিশকে ঘুষের সঙ্গে জড়াতে দেখি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, আটকে রেখে নির্যাতনে সাধারণ মানুষের মৃত্যু দেখি। এগুলো অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। সাধারণ তিরস্কার, ভর্ৎসনা, প্রত্যাহার বা বেতন-গ্রেড সাময়িক স্থগিত বা কমিয়ে পুলিশে অপরাধপ্রবণতা কমানো সম্ভব না। এখন মূল বিষয় হচ্ছে, এখান থেকে পুলিশকে আমরা যদি জনগণের বন্ধুর জায়গায় নিতে চাই বা আদর্শিক অবস্থানে নিতে চাই তাহলে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ঠিক সেটাই নিতে হবে।
একই প্রসঙ্গে সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘কোনো অপরাধী চক্রের সঙ্গে যখন পুলিশ সদস্য যুক্ত থাকে তখন সেই পেশাদার অপরাধীর সাহস ও উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। পুলিশ সদস্য নিজেই যখন অপরাধী হয়ে যায় তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আর স্বাভাবিক থাকে না, মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জনগণও আস্থা হারায়। পুলিশ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলে সমাজে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। পুলিশ প্রশাসনকে প্রতিটি সদস্যের বিষয়ে খোঁজখবর ও নজরদারি আরও বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।’