স্টাফ রিপোর্টার:
করোনা পরবর্তী সময়ে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। করোনার পরের সময়ে অনেকে অর্থ সংকটে পড়েছেন। আবার অনেকের, সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার ওপর নতুন করে যোগ হয়েছে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির মতো সমস্যাও। এসব কারণে মূলত খুনখারাবির মতো অঘটন বেড়েছে। এরপরে ছোটখাট বিষয় নিয়ে বড় ঘটনাও ঘটছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন শাবিপ্রবি’র সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. তানজিনা চৌধুরী।
আম্বরখানা-বড়বাজার সড়ক সিলেট নগরীর একটি ব্যস্ততম এলাকা। দিনে কিংবা রাতে সড়কটিতে বিপুল সংখ্যক যানবাহন চলাচল করে। এই সড়কেই প্রকাশ্যে- জনসমক্ষে খুন হন সিলেট জেলা বিএনপি নেতা আ ফ ম কামাল। সিলেট ল’কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস কামালকে নিজ গাড়ীর ড্রাইভিং সিটেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার তুলাপুর গ্রামে জমি-জমা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এর জের ধরে প্রতিপক্ষের হাতে হেলাল মিয়া ও কাজল মিয়া নামের দুই সহোদরকে হত্যা করা হয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পার্শ্ববর্তী গাজীকালুর টিলায় খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদ। শাল্লার নারকিলা গ্রামের এক তরুণের সাথে আরেক তরুণীর প্রণয় চলে আসছিল। মেয়ের প্রেমের খেসারত দিতে গিয়ে খুন হন হতভাগ্য পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন। গোয়াইনঘাটের দক্ষিণলাবু গ্রামে প্রতিপক্ষের লোকজনের বর্বর হামলার শিকার হয় একটি পরিবার। হামলার পরপরই নিহত হন যুবক আব্দুল কাদির। গর্ভের ধন আব্দুল কাদিরকে রক্ষা করতে আসা মা হাসিনা বেগমও গুরুতর আহত হন। পরে তিনিও মারা যান। নারী সেজে মাওলানা কাওসারের সাথে প্রেম করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শামসুল। এই শামসুল পহেলা বৈশাখের দিন মাওলানা কাওসারকে ডেকে নিয়ে জাফলংয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়। শহরতলীর শাহপরান এলাকায় ঘাতক মা নাজমিন হোসেন গলা টিপে হত্যা করে তার শিশু কন্যা সাবিহা আক্তারকে। আর জগন্নাথপুরে সৌদি প্রবাসীর স্ত্রী শাহনাজ পারভিন জ্যোৎস্মাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। জবাই করেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকেরা; পারভীনের লাশকে ৬ টুকরো করে। জামালগঞ্জে পুত্রের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে দেবরের দায়ের কোপে নিহত হন সুলেখা বেগম। সিলেট বিভাগে বিদায়ী বছরে শতাধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হলেও এ সকল হত্যাকান্ড ছিল সবচাইতে আলোচিত।
জনসম্মুখে বিএনপি নেতা কুপিয়ে হত্যা
নগরীর আম্বরখানার বড়বাজার সড়কে সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক আ ফ ম কামালকে (৪২) প্রকাশ্যে জনসমক্ষে গাড়ির ভেতরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৬ নভেম্বর রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় ওই এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। সেসময় একটি প্রাইভেট কার মোটরসাইকেলের সঙ্গে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে মনে করে পথচারীরা মোটরসাইকেল ও কারটিকে সরাতে গেলে কামালের রক্তাক্ত দেহ গাড়ির ভেতর দেখতে পান। পরে স্থানীয়রা তাকে দ্রুত ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
জমিজমা নিয়ে রাজনগরে সহোদর খুন
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের তুলাপুর গ্রামে জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২৩ সেপ্টেম্বর সৃষ্ট ব্যাপক সংঘর্ষে ওই গ্রামের নূর মিয়ার দুই পুত্র হেলাল মিয়া (৪০) ও কাজল মিয়া (২২) নিহত হন। ঘটনার দিন রাজু দাশের লোকজন বিরোধপূর্ণ জায়গায় গাছ রোপণ করতে গেলে ধীরু দাশের সাথে প্রতিপক্ষ রাজু দাশের মধ্যে কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এসময় স্থানীয় ইউপি সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলে তার ওপরও হামলা করা হয়। হামলায় গুরুতর আহত হেলাল মিয়া ও কাজল মিয়াকে হাসপাতালে নেয়ার পথে তাদের মৃত্যু হয়।
নিজ ক্যাম্পাসের অদূরে শাবি ছাত্র খুন
২৫ জুলাই রাত ৮টার দিকে শাবিপ্রবি’র গাজীকালুর টিলায় ছুরিকাঘাতে খুন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বুলবুল আহমেদ। নিহত বুলবুল নরসিংদী সদরের চিনিশপুর নন্দিপাড়ার ওহাব আলীর পুত্র। তার বুকে ও হাতে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনায় শাবির শিক্ষার্থীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন।
শাল্লায় মেয়ের প্রেমের খেসারত
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নারকিলা গ্রামে গত ৩১ অক্টোবর দিবাগত রাত ১টায় মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে খুন হন প্রেমিকার পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন (৫০)।
পুলিশসহ স্থানীয় সূত্রমতে, ওই গ্রামের মোতলিব মিয়ার ছেলে মুতাব্বির হোসেনের সাথে জাহাঙ্গীর হোসেনের মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মুতাব্বির হোসেনের পার্শ্ববর্তী উপজেলার ভরাগাঁও গ্রামে বিয়ে পাকাপোক্ত হলে জাহাঙ্গীর হোসেনের মেয়ে মোতলিব মিয়ার বাড়িতে চলে যায়। এর জের ধরে মোতলিব লোকজনের সাথে জাহাঙ্গীরের বাকবিতন্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে মোতলিবের লোকজন জাহাঙ্গীর হোসেনকে মারধর করেন। পরে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
বালুচরে তালাবদ্ধ ঘরে নারীর বীভৎস লাশ
সিলেট নগরের বালুচর (ফোকাস-৩৬৪) নম্বর বাসার তালাভেঙ্গে গত ২৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওমান প্রবাসীর স্ত্রী আফিয়া বেগম (৩১)-এর লাশ উদ্ধার করা হয়।
সিকান্দর মহল নামের পাঁচতলার ওই বাসার নিচতলায় মেয়েকে নিয়ে থাকতেন ওমান প্রবাসীর স্ত্রী আফিয়া বেগম। ২৪ আগস্ট রাতে বাসার ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ায় বাসার অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে খাটের উপর ওই নারীর বীভৎস লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এসময় নিহতের দুই বছর বয়সী কন্যা সন্তানকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
পূর্ব শত্রুতাঃ গোয়াইনঘাটে মা-ছেলে খুন
সিলেটের গোয়ানইঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের দক্ষিণলাবু গ্রামের আব্দুল খালিকের বাড়িতে পূর্ব শত্রুতার জেরে ১৫ জুলাই শুক্রবার রাত আটটার দিকে প্রতিপক্ষের লোকজন অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় আব্দুল খালিকের ছেলে আব্দুল কাদিরকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। টগবগে যুবক আব্দুল কাদিরকে গলা কেটে হত্যা করেই প্রতিপক্ষের লোকজন ক্ষান্ত হয়নি; তারা নিহত আব্দুল কাদিরের বসতঘরেও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় নিহতের পরিবারের অন্য সদস্যদের উপরও হামলা চালায়। হামলায় নিহতের মা হাসিনা বেগম (৫৫) গুরুতর আহত হন। ঘটনার দুদিন পর ওসমানী হাসপাতালে হাসিনা বেগমও মারা যান।
নারী সেজে প্রেম অতঃপর খুন
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সামিয়া জাহান নামের নারী সেজে জগন্নাথপুর উপজেলার কালাম-বহরপুর গ্রামের বাসিন্দা কাওসার আহমেদ (৩৪) এর সাথে প্রেম করছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শামসুল ইসলাম (২৮) নামের এক যুবক। একসাথে ঘুরে বেড়ানোর কথা বলে ওই শিক্ষককে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিন জাফলং ডেকে নিয়ে হত্যা করেন শামসুল। হত্যার আগে ঘাতক নিহত ব্যক্তিকে পিস্তল সদৃশ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্ত্রীর কাছে ফোনে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ দিতে অপারগতা জানালে জাফলং জিরো পয়েন্টে নিয়ে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরে পুলিশ পুরো ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে।
মা বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করল মেয়েকে
গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সিলেট নগরীর শাহপরান এলাকায় স্বামী প্রবাসী সাব্বির আহমদের সাথে বিরোধের জের ধরে মা নাজমিন আক্তার তার শিশু কন্যা সাবিহা আক্তারকে নিজে বালিশ চাপা দিয়ে ও শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। নাজমিনের সাথে ২০১৫ সালে সাব্বির আহমেদ নামের ওই প্রবাসীর বিয়ে হয়। একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন নাজমিন। এর আগেও একটি বিয়ে হয়েছিল নাজমিনের। সেই সংসারে তাঁর একটি সন্তান রয়েছে। মেয়েকে হত্যার পরে নাজমিন নিজে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে বলেন, স্বামী সাব্বির ও তার পরিবারের লোকজনের কুৎসা রটনা ও অপপ্রচারের দু:খে তিনি মেয়েকে হত্যা করেছেন।
জগন্নাথপুরে প্রবাসীর স্ত্রীর ৬ টুকরো লাশ
জগন্নাথপুর পৌর পয়েন্টের মির্জা আব্দুল মতিন মার্কেটের অভি মেডিকেল হল নামের তালাবদ্ধ ফার্মেসি থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে শাহনাজ পারভিন জ্যোৎস্না (৩৫) নামের এক নারীর ৬ টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি উপজেলার নারিকেলতলা গ্রামের সৌদি প্রবাসী সুরুক মিয়ার স্ত্রী ও তিন সন্তানের জননী। ঘটনার আগের দিন সকালে অভি মেডিকেল হলের মালিক জিতেন্দ্র গোপ ওই নারীর বাসায় গিয়ে প্রেসার (রক্তচাপ) মাপার জন্য শাহনাজকে তার ফার্মেসিতে যেতে বলেন। এরপর ওই মহিলা ফার্মেসিতে ঔষধ আনতে গেলে আর ফিরে আসেননি। পরে ফার্মেসিতে মহিলার সন্ধান পাওয়া গেলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাজেদুর রহমানের উপস্থিতিতে জগন্নাথপুর থানার ওসি মিজানুর রহমান একদল পুলিশ নিয়ে ওই ফার্মেসীর তালা ভাঙেন। ফার্মেসির ভেতরে শাহনাজ পারভিনের ছয় টুকরো লাশ পাওয়া যায়।
ছেলের প্রাণ রক্ষায় খুন হলেন মা
জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের চানবাড়ি গ্রামের আকমল হোসেনের জমি নিয়ে আপন ছোট ভাই একরামুল হকের সাথে পূর্ব বিরোধ ছিল। বিরোধপূর্ণ জমিতে তৈরি করা খলায় ধান শুকানোকে কেন্দ্র করে আবারও বিরোধ দেখা দেয়। একরামুল হক উত্তেজিত হয়ে তার ভাবী সুলেখা বেগমকেও গালিগালাজ করেন। এসময় সুলেখা বেগমের বড় ছেলে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী সাইদুল হক এগিয়ে গেলে একরামুল তাকে দা দিয়ে কোপ মারেন। তখন সাইদুল হককে সরিয়ে দেওয়ায় কোপটি তার গায়ে না লেগে সুলেখা বেগমের মাথায় লাগে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তাকে সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। ১৩ মে ওসমানীর আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়।