স্টাফ রিপোর্টার:
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে নানা নাটকীয়তা চলছে। বর্তমানে দেশটির শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য খোলা থাকলেও সেটি অনেকটা অচল অবস্থায় আছে। দেশটিতে প্রত্যাশিত শ্রমিক পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারটির জটিলতা নিরসনে আলোচনা করতে সংক্ষিপ্ত সফরে নেপাল হয়ে শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকায় আসছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল।
তার সফরে শ্রমবাজারটি গতিশীল করতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) পরিবর্তন, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় কমানোসহ দেশের সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য বাজার উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দেবে ঢাকা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শ্রমবাজারের জটিলতা নিয়ে আলাপ করবেন। কীভাবে দেশটিতে আমরা সহজে কর্মী পাঠাতে পারি; সেগুলো আলোচনায় আসবে। এক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাব আমাদের দিক থেকে দেওয়া হবে। আমাদের কর্মীদের স্বার্থ আগে। আমরা চাই, সবার জন্য বাজার খুলে দেওয়া হোক। নিয়াগকর্তার পছন্দ মতো রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়োগ— এটা আমরা চাই না। অভিবাসন ব্যয় আরও কমানো দরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২৪ ঘণ্টার সফরে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পাশাপাশি তিনি সেনা কল্যাণ সংস্থার সঙ্গেও একটি বৈঠক করবেন। রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে তিনি ঢাকা ছেড়ে যাবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এ সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে কর্মী পাঠানো নিয়ে আমরা চুক্তি করলেও বাজারটি কিছুটা অচল অবস্থার মধ্যে চলছে। প্রত্যাশিত পর্যায়ে শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে না। শ্রমিক যেতে পারছেন না। অথচ মালয়েশিয়ার শ্রমিক চাহিদা অনেক বেশি। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আমরাও হচ্ছি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর দু’দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করছি, বাজার নিয়ে যেসব জটিলতা আছে সেগুলো দূর করা হবে। আমাদের শ্রমিকদের যাওয়ার পথ সুগম হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশটির শ্রমবাজারের ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছেন। নতুন করে এটি ঢেলে সাজাতে এবং অনিয়ম দূর করতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কর্মীসংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকেও এ বিষয়ে সহযোগিতা চাচ্ছে দেশটি। এরই ধারাবাহিকতায় নেপাল ও বাংলাদেশ পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিনকে।
১০ এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর শ্রমবাজারটি বন্ধ থাকার পর ঢাকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় দেশটিতে নতুন করে কর্মী পাঠাতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে দুই দেশ। চুক্তি সইয়ের পরের মাস থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা।
কিন্তু কর্মী পাঠানো শুরুর আগেই নতুন শর্ত আসে কুয়ালালামপুরের পক্ষ থেকে। তৎকালীন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী সারাভারান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীকে এক চিঠি দিয়ে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগের বার্তা দেয়। ঢাকা এ শর্ত মেনে নিতে রাজি হয়নি। ফিরতি বার্তায় নিবন্ধিত এক হাজারের বেশি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ।
রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়ে শুরু হওয়া নাটকীয়তা বন্ধে গত বছরের জুনের শুরুতে তৎকালীন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রীকে একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ঢাকায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী। তার দুই মাস পর ২০২২ সালে হওয়া চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ৯ আগস্ট মালয়েশিয়ায় ৫৩ কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে জটিলতা কেন— জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দিক থেকে যেটা দেখা যাচ্ছে, মূল সমস্যাটা মালয়েশিয়া প্রান্তে। আমাদের দিক থেকেও কিছু সমস্যা আছে। রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়েই তো মূল সমস্যা। দুই প্রান্তে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যদি অ্যাকটিভ না হয় এমওইউ সাইন করে কোনো কাজ হবে না। কেননা মাঠে কিন্তু তারাই প্লেয়ার।
এ কর্মকর্তা বলেন, একটা বছর জটিলতায় নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ধারণা, মালয়েশিয়ার নতুন সরকার বিষয়টাকে খুব ভালোভাবে নিচ্ছেন। সৃষ্ট জটিলতা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসা দরকার। আমাদের লোকও যাওয়া দরকার।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেনা কল্যাণ সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে দেশটিতে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগের বিষয়ে আলাপ করবেন বলে ধারণা দেন এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সেনা কল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে আমাদের সাবেক সেনা, তাদের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে মালয়েশিয়ায় রিক্রুট করার একটা প্রক্রিয়া আছে। এটা নিয়ে একটা চুক্তিও আছে। সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগের বিষয়ে আলাপ হতে পারে।
গত ৩০ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের কারণ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল সাংবাদিকদের বলেন, তিনি (মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) ঢাকায় আসবেন। আমরা যে কর্মী পাঠাই, এগুলোতে অনেক সময় উল্টাপাল্টা কাজ হয়। তিনি আসছেন এগুলো ঠিক করার জন্য।
মোমেন বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, তিনি আসার পর মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে যে কার্টেল (মধ্যস্বত্বভোগী চক্র) আছে, সেগুলো দূর হবে। ফলে বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা হয়তো স্বল্প খরচেই মালয়েশিয়া যেতে পারবেন।’