স্টাফ রিপোর্টার:
বাবার সঙ্গে মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে যায় শিশু ইব্রাহিম। পাশে দাঁড়িয়ে এক রাকাত নামাজও পড়ে। দ্বিতীয় রাকাতের সময় শিশুটি বাবার পাশ থেকে সরে যায়। নামাজ শেষে ইব্রাহিমের বাবা সন্তানকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। তবে দুই বছর তিন মাস বয়সী ইব্রাহিমকে আর পাননি তিনি।
গত ১১ আগস্ট রাজধানীর মহাখালী সাততলা সংক্রামক ব্যাধি জামে মসজিদে এ ঘটনা ঘটে। এরপর ২৭ দিন পার হলেও শিশুটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
শিশুটির বাবার নাম রানা মিয়া। তিনি মহাখালী কলেরা হাসপাতালে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। মসজিদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তিনি জানতে পারেন, তার শিমু চুরি হয়েছে। মসজিদের সামনে থেকে একজন নারী তার শিশুকে কোলে করে পালিয়ে গেছেন।
শিশু ইব্রাহিমকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রেশমা আক্তার ইভা। ছেলের শোকে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। যাকেই দেখছেন, তার কাছে ছেলের সন্ধান চাইছেন। মাঝে মধ্যেই ডুকরে কাঁদছেন। ‘আল্লাহ, আমার বাবারে ফেরত দাও। আমার কোলে ফিরিয়ে দাও’ বলে বিলাপ করছেন মা।
বাবা মো. রানা মিয়া দিনরাত আক্ষেপ করছেন কেন মসজিদে নিয়ে গেলেন ছোট্ট শিশুসন্তানকে। চোখের পলকে হারিয়ে যাওয়া বুকের মানিককে যেকোনো মূল্যে ফেরত চান তিনি।
ঘটনার পর শিশুর বাবা বাদী হয়ে বনানী থানায় মামলা করেন। ইব্রাহিমের খোঁজে বনানী থানা পুলিশের সঙ্গে মাঠে নেমেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। র্যাবও উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে ইব্রাহিমের নিখোঁজ নিয়ে একপ্রকার অন্ধকারে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনাস্থলের আশপাশের বেশিরভাগ সিসি ক্যামেরা অকেজো ছিল। যতটুকু ফুটেজ পাওয়া গেছে, তা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভিক্ষুকের বেশে চল্লিশোর্ধ্ব এক নারী শিশুটিকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছেন। ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরে গিয়ে নিকেতন বাজার থেকে রিকশায় ওঠেন ওই নারী। মহাখালী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত যাওয়ার তথ্য পেয়েছেন তারা। এরপর আর কোনো হদিস মেলেনি ওই নারী ও শিশু ইব্রাহিমের।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ইব্রাহিমকে অপহরণের সম্ভাব্য তিন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম মুক্তিপণ আদায়। এছাড়া পূর্বশত্রুতা ও ভিক্ষাবৃত্তির কাজে ব্যবহার। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে তদন্ত চলছে। তবে অপহরণকারী ওই নারীর বেশভূষা দেখে ভিক্ষুক মনে হচ্ছে না। শিশুটির খোঁজে দেশের সব থানায় ছবি পাঠানো, বেতার বার্তা পাঠানোসহ সোর্সও লাগিয়েছে ডিবি। এরপরও ঘটনার কোনো ক্লু পাচ্ছে না তদন্ত সংস্থাগুলো।
মসজিদের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, শিশুটিকে নিয়ে নীল রঙের বোরকা পরা এক নারী তড়িঘড়ি করে দৌড়ে যাচ্ছেন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, দৌড়ে গিয়ে একটি রিকশায় উঠছেন ওই নারী।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে শিশুটির বাবা রানা মিয়া বলেন, ১১ আগস্ট সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ চলাকালে এক রাকাতের পর দ্বিতীয় রাকাতের আগে আমার পাশ থেকে হঠাৎ বাইরে চলে যায় ইব্রাহিম। নামাজ শেষ করে আর তাকে খুঁজে পাইনি। পরে বনানী থানায় মামলা করি। ডিবি ও র্যাবকেও জানিয়েছি, কিন্তু আমার ছেলের কোনো সন্ধান পাচ্ছি না।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, শিশুটিকে উদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ডিবির চার সদস্যের টিম এরই মধ্যে দেশের একাধিক জেলায় অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে মহাখালী বাস টার্মিনালের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যায়নি। ফুটেজ পাওয়া গেলে দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব হতো।
এদিকে, এ ঘটনা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রতারকচক্রগুলো। ছেলের খোঁজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইব্রাহিমের ছবি ও তার নিজের ফোন নম্বর দিয়ে প্রচারণা চালানোর পর প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ফোন করে টাকার বিনিময়ে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছে বলে জানান রানা মিয়া।
রানা মিয়া বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় প্রতিদিনই ফোন আসছে। এর মধ্যে দুজন ব্যক্তি ফোন করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে শিশুকে ফেরত দেওয়ার কথা জানান। অন্যজন ভারতের হরিদাসপুর থেকে ফোন করে জানান, শিশু ইব্রাহিমকে তিনি দেখেছেন। ১১ হাজার টাকা দিলে সন্ধান জানাবেন। তাকে ছবি পাঠাতে বললে ফেসবুকে যে ছবি আমি পোস্ট করেছি, সেটাই পাঠিয়েছেন।