অনুপম হায়াৎ:
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যেমন ‘আগুনের গোলা সদৃশ’ তেমনি ভাব-ভাষা-ছন্দ-গাঁথুনি-কল্পনা-ব্যঞ্জনা ও চেতনায় ‘নব’ এবং ‘অভিনব’। চিরতারুণ্যের প্রেরণাজ্ঞাত এই কবিতা নজরুলকে দিয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ অভিধা। বিশিষ্ট মার্কিন পণ্ডিত ড. হেনরী গ্ল্যাসি বিশ শতকে রচিত দুটি শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ একটি বলে মন্তব্য করেছেন। (অধ্যাপক ড. হেনরী ল্যাসি প্রদত্ত ভাষণ, বাংলা একাডেমি, বর্তমান লেখক ঐ অনুষ্ঠানে উপস্হিত ছিলেন এবং তা উদ্ধৃত করেছেন তাঁর ‘প্রামাণ্য নজরুল’ গ্রম্হে, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ-৪১)
এই কবিতাটি রচনায় স্হান, সময়, তারিখ এবং প্রথম প্রকাশ সম্পর্কে মুজফফর আহমদ যে তথ্যজ্ঞাপন করেছেন, প্রায় সব নজরুল গবেষক, লেখক-ব্যাখ্যাকার, জীবনীকারই সেই তথ্য গ্রহণ করেছেন। মুজফফর আহমদ যেসব তথ্য পরিবেশন করেছেন, তা হলো
১. ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুল রচনা করেছিলেন মুজফফর আহমদের কলকাতার ৩/৪-সি তালতলা লেনের দোতলা বাড়ির নিচতলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরে, ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো এক তারিখের রাত দশটা থেকে ভোরের মধ্যে; ২. সকালে মুজফফর আহমদকেই প্রথম কবিতাটি পড়ে শোনান নজরুল; ৩. নজরুল কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিলেন; ৪. ‘বিদ্রোহী’ কবিতার দ্বিতীয় শ্রোতা হলেন মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজাল-উল-হক; ৫. নজরুল কবিতাটির একটি কপি করে তাঁকে দেন ‘মোসলেম ভারত’-এ ছাপানোর জন্য; ৬. পরে কবিতাটির আরেকটি কপি নিয়ে যান অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য; এবং ৭. কবিতাটি ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ পৌষ, শুক্রবার) ‘বিজলী’তে প্রথম ছাপা হয়।
এই তথ্যগুলো আমরা পাই—১৯৭৬ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মুজফফর আহমদের ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ গ্রম্হে (পৃ. ১৮৮-১৯২)। ঐ গ্রম্হে তিনি জানিয়েছেন যে, ইতোপূর্বে তিনি ‘কাজী নজরুল প্রসঙ্গে’ নামক পুস্তকে লিখেছেন যে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের দুর্গা পূজার সময়ে লিখেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি লিখেন যে, এটি ভুল তথ্য। এজন্য নিজেকে দায়ী করে লেখেন, ‘আমি বড় অন্যায় কাজ করেছি এবং এই অসাবধানতার জন্য আমি মর্মান্িতকভাবে দুঃখিত।’ মুজফফর আহমদ আরো জানিয়েছেন যে, আফজাল সাহেব যখন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কপি নজরুলের কাছ থেকে নেন তখন পৌষ মাস চলছিল আর ‘মোসলেম ভারত’-এর কার্তিক সংখ্যা তখনো বের হয়নি। এই পত্রিকার কার্তিক সংখ্যা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাসহ ফাল্গুন মাসের আগে বের হয়নি। কাজেই ‘বিদ্রোহী’ প্রথম ছাপানোর সম্মান সাপ্তাহিক ‘বিজলী’রই প্রাপ্য। পৌষ মাসের আগে নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনাই করেননি।
কিন্তু, আমরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম প্রকাশ ও পরবর্তী প্রকাশ সম্পর্কে সন, তারিখ ও পত্রিকা অনুযায়ী ক্রম ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্য তথ্য পাই নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে। তিনি তাঁর ‘নজরুল নির্দেশিকা’ গ্রম্হে (১৩৭৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত, পৃ. ১৪) লিখেছেন যে, নজরুলের ‘কামাল পাশা’ ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাপা হয় কলকাতার মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক অর্থাত্ ১৯২১ খ্িরষ্টাব্দের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায়।
আর সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তে ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হয় ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ পৌষ অর্থাত্ ১৯২২ খ্িরষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি সংখ্যায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পুনর্মুদ্রিত হয় মাসিক ‘প্রবাসী’তে ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ অর্থাত্ ১৯২২ খ্িরষ্টাব্দের জানুয়ারি-ফেব্র‚য়ারি সংখ্যায়।
রফিকুল ইসলামের ‘নজরুল নির্দেশিকা’ গ্রম্হে আমরা আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই। তিনি ১৯২২ সলের ৬ জানুয়ারি অর্থাত্ ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ পৌষ তারিখের সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তে প্রকাশিত ‘মোসলেম ভারত’ ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যার সমালোচনা উদ্ধার করেছেন। উল্লেখ্য, মোসলেম ভারত’-এর ঐ সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল নজরুলের দুটি কবিতা ‘কামাল পাশা’ ও ‘বিদ্রোহী’। (কার্তিক ১৩২৮, দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ১৯২১ সালের নভেম্বর)। ‘বিজলী’তে (২২ পৌষ, ১৩২৮) সমালোচনা প্রসঙ্গে লেখা হয়: ‘কামাল পাশা’ হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা। কবিতাটি যুদ্ধের মার্চের ছন্দে গাঁথা। এরূপ কবিতা বোধহয় বাংলার কাব্যসাহিত্যে এই প্রথম। ‘বিদ্রোহী’ কাজী সাহেবের আর একটি কবিতা। কবিতাটি এত সুন্দর হয়েছে যে, আমাদের স্হানাভাব হলেও তা ‘বিজলী’র পাঠক-পাঠিকাদের উপহার দেয়ার লোভ আমরা সংবরণ করতে পারলাম না। (উদ্ধৃত, রফিকুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবন ও কবিতা, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ: ৮১-৮২)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ‘মোসলেম ভারত’ (কামাল পাশা ও বিদ্রোহীসহ)-এর কার্তিক সংখ্যা যদি ফাল্গুন (১৩২৮) মাসে ছাপা হয়ে থাকে, তবে ‘বিজলী’র পৌষ মাসের ২২ তারিখের (১৩২৮) সংখ্যায় কী করে এর সমালোচনা বের হয়?
প্রকাশের তারিখ দেখে এটা প্রমাণিত হয় যে, ‘বিদ্রোহী’ প্রথমে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকাতেই আসলে ছাপা হয়েছিল এবং সেটা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ (১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি) তারিখের আগে। তবে তা মাঘ বা ফাল্গুন মাসে নয়।
‘বিদ্রোহী’ যে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশ ও ছাপা হয়েছিল তার অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যয় নবম পৃষ্ঠায় শানাই-র পোঁ বিভাগে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়। সেলিনা বাহার সম্পাদিত ‘নজরুলের ধূমকেতু’ (২০০১ সালে প্রকাশিত, পৃ. ৯) গ্রম্হে বলা হয়—‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পুনমুর্দ্রণকালে কবিতার নিচে ফুটনোটে ‘ধূমকেতু’র সহকারী সম্পাদক লিখেছেন: এই কবিতাটি প্রথমে ‘মোসলেম ভারত’-এ বের হয়। পরে এটা ‘বিজলী’, ‘প্রবাসী’ প্রভৃতি পত্রিকায় উদ্ধৃত হয়। অনেক পাঠক কবিতাটি সম্পূর্ণভাবে পাওয়ার জন্য ঐ সংখ্যার ‘মোসলেম ভারত’ কিনতে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন; কেননা ঐ সংখ্যার পত্রিকা এত বেশি নগদে বিক্রি হয়ে গেছে যে, ‘মোসলেম ভারত’-এর গ্রাহকগণ ছাড়া এখন আর কাউকেই দেয়া যাচ্ছে না। সেই জন্যে অনেকের অনুরোধে আমরা কবিতাটি ‘ধূমকেতু’তে উদ্ধৃত করে দিলাম। প্রার্থনা, কেউ যেন এটা আমাদের ধৃষ্টতা বলে মনে না করেন: সহকারী সম্পাদক। উল্লেখ্য, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পরে নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২) কাব্যগ্রম্হভুক্ত হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রামাণিক তথ্যের আলোকে নজরুল ইসলাম রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম প্রকাশের সন, তারিখ ও পত্রিকার নাম নিম্নে দেওয়া হলো:
উপরিউক্ত তথ্যালোকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বিজলী’ ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় পরে এটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল মাত্র।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম প্রকাশ সম্পর্কে আমরা কি মুজফফর আহমদের ‘স্মৃতিকথা’ (১৯৫৯) সঠিক বলে ধরে নেব নাকি নজরুলের নিজের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ সময়েরই তথ্য সত্য বলে ধরে নেব?