কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি:
কিশোরগঞ্জে পোস্ট অফিসে রাখা মায়ের সঞ্চয়পত্রের প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে মাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে ছেলের বিরুদ্ধে। নিহতের দুই মেয়ে মরদেহ ময়নাতদন্তের দাবি করলেও তা উপেক্ষা করে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় দুই মেয়ে পৃথকভাবে আদালতে হত্যা ও প্রতারণার মামলা করেছেন।
মামলায় ভাই সারোয়ার জাহান (৫০), তার স্ত্রী সাবিকুন্নাহার (৪৫) এবং তাদের ছেলে-মেয়ে এবং পোস্ট অফিসের কর্মচারীসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আদালত অভিযোগটি তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দিয়েছেন।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইদ্রিছ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বত্রিশ মনিপুর এলাকার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান কবিরের স্ত্রী ফরিদা খাতুন (৬৯) সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি করতেন। তার স্বামী শাহজাহান কবিরও বিআরডিবিতে চাকরি করতেন। স্বামী মারা গেছেন ২০০৭ সালে। ফরিদা খাতুন স্বামীর পেনশনের টাকা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা এবং নিজের টাকা মিলিয়ে পোস্ট অফিসে ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রাখার মনস্থির করেন এবং দুই মেয়ে লীনা জাহান তান্নী এবং নুসরাত জাহানকে নমিনি করার সিদ্ধান্ত নেন। ফরিদা খাতুন তার ছেলে সারোয়ার জাহানকে বিষয়টি জানান এবং পোস্ট অফিস থেকে সঞ্চয়পত্রের ফরম আনতে বলেন। সারোয়ার জাহান ফরম এনে মায়ের স্বাক্ষর নিয়ে তাতে নমিনি হিসেবে দুই মেয়ের নাম লিখে দুই মেয়ের ছবি ও আইডি কার্ডের কপি নিয়ে ২০১৭ সালের ১৮ মে পোস্ট অফিসে যান। সেখানে পোস্ট অফিসের অসৎ কর্মচারীদের যোগসাজশে ফরমটি ছিঁড়ে ফেলে নতুন একটি ফরমে মায়ের স্বাক্ষর জাল করে তাতে সারোয়ার জাহান নিজেকে নমিনি হিসেবে উল্লেখ করে ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র করে আসেন এবং সঞ্চয়পত্রের যাবতীয় কাগজপত্র তার কাছেই রেখে দেন।
২০২২ সালের ১৮ মে সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে সুদে আসলে ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা হয়। এমতাবস্থায় গত ২১ জুলাই সারোয়ার জাহান সমুদয় টাকা উত্তোলন করে নিয়ে আসেন। পরদিন মাকে তার কক্ষে রাত ৮টার দিকে অমানুষিক নির্যাতন করে আসামিরা হত্যা করে দুই ঘণ্টা পর শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ভিকটিম আরও দুই ঘণ্টা আগে মারা গেছেন বলে ঘোষণা দেন। এরপর আসামিরা ঘটনা গোপন রাখার জন্য ঢাকা থেকে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি এনে এলাকার লোকজন জানার আগেই স্বামীর গ্রামের বাড়ি কুলিয়ারচরের লক্ষ্মীপুর ভাটিপাড়া এলাকায় ময়নাতদন্তের দাবি উপেক্ষা করে স্বামীর কবরের পাশে মরদেহ দাফন করে।
এরপর মেয়ে লীনা জাহান তান্নী কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করতে গেলে কর্তব্য পুলিশ কর্মকর্তা তাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন। ফলে লীনা জাহান তান্নী গত ১৬ আগস্ট ১নং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দণ্ডবিধির ৩০২/১০৯/৩৪ ধারায় মামলা রুজু করেন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৬ ধারার ২ উপধারা মতে কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের আবেদন জানান।
আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদুল আমিন গত ২৪ আগস্ট মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সিআইডি আদেশের কপি গ্রহণ করেছে ১ সেপ্টেম্বর।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইদ্রিছ আলী জানান, ভিকটিম যেহেতু সমাহিত। ফলে সিআইডিকে তদন্তের আদেশের মাধ্যমে বস্তুত মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও ভিকটিম ফরিদা খাতুনকে আগে থেকেই ছেলে সারোয়ার জাহান অত্যাচার-নির্যাতন করতেন বলে সদর থানায় মায়ের নিজের জিডি রয়েছে। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর করা ৮৫ নং জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ছেলের নামে জায়গা-সম্পত্তি হেবা করে দেওয়ার পর তাকে ভরণপোষণ না দিয়ে ছেলে ও ছেলের বউ শারীরিকভাকে অত্যাচার-নির্যাতন করছেন এবং বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পাঁয়তারাসহ খুন-জখমের হুমকি দিচ্ছেন। জিডি করার দিনও এরা সকালে বাদীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে না গেলে খুন-জখমের হুমকি দেন বলে জিডিতে উল্লেখ রয়েছে।
এ ঘটনায় ভিকটিমের দুই মেয়ে লীনা জাহান তান্নী ও নুসরাত জাহান সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।