আবুল বাশার:
উপমা মানে তুলনা। কোনো বিষয়কে বা ব্যাপারকে সহজ করে বোঝানোর জন্য ব্যাপারটিকে বা বিষয়টিকে পরিচিত কোনো বস্তু বা বিষয়ের সঙ্গে আমরা তুলনা করে থাকি। আমাদের মনের রকম-সকমই এরকম।
এই তুলনা চোখের সামনে নেই, এমন বস্তু হলেও আপত্তি করে না মানুষের মন। মানুষের এই যে স্বভাব, তা বিচিত্রই বটে, অর্থাৎ উপমা দেওয়াটা মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাও নিশ্চয়। ফের এই জাতীয় তুলনা করতে গিয়ে কল্পনার আশ্রয় নেন কবিরা বা শিল্পীরা। এমনকি মানুষেরাও। এই কল্পনার নাম একটা চাই; ফলত জীবনানন্দ দাশ সেই কল্পনার নাম দিয়েছেন ‘কল্পনার প্রতিভা’। এক্ষেত্রে কল্পনা কথাটি কবিপ্রতিভার বিশেষণবিশেষ। এই মহাকবিই বলেছেন, ‘উপমাই কবিত্ব’।
উপমার ওপর এত জোর দিলেন কেন জীবনানন্দ? আমাদের বিচারে উপমা ও রূপকের (রূপকও তুলনানির্ভর) পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত— ইহকাল-পরকালপ্লাবী; সাহিত্যের ও মানবজীবনের মহার্ঘ সম্পদ এই তুলনামূলকতা। এ কিছুতেই সামান্য কিছু নয়; জল পড়ে পাতা নড়ে নয়।
রূপক ও উপমার সাহায্যে কোনো কিছুকে কীরূপে সহজ করে বোঝানো সম্ভব হয়, তার দৃষ্টান্ত ধর্মশাস্ত্রের পাতায় অনবদ্য উদ্ভাস জমা হয়ে রয়েছে। আমরা আল কোরআনের বয়ান অবলীলায় টেনে আনতে পারি।
আমি স্যার সৈয়দ আমীর আলীর লেখা ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’—নামের মহত্ আলোচনাগ্রন্থ থেকে একটি বিশিষ্ট উদ্ধৃতি এখানে মেলে ধরব, ঐ উদ্ধৃতির মধ্যে কোরআনের স্পিরিট ও টেম্পারামেন্ট ঝিনুকে বিধৃত মুক্তোর মতো ধরা রয়েছে—যে মুক্তো খোদায়ি প্রজ্ঞা-সমুদ্রে সুলভ।
কথাগুলো এরকম, যা আমীর আলী চয়ন করেছেন, ‘আল্লাহ—তিনিই তো আসমান-জমিনের জ্যোতি। তার এই নুরের উপমা হলো—ঠিক যেমন একটি তাকের ওপর একটি প্রদীপ জ্বলছে। আর সেই প্রদীপটি একটি কাচের চিমনির মধ্যে রয়েছে। আর তা যেন একটি উজ্জ্বল তারকা। এই প্রদীপটি জ্বালানো হয়েছে কল্যাণপূত জলপাইগাছের তেল থেকে—যে গাছ পূর্ব-পশ্চিম কোনো মুখীই নয়, আর তেল অগ্নিসংযোগ ছাড়াই উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ করে। এ হলো আলোর আলো। জ্যোতির জ্যোতি। আল্লাহ যাকে খুশি তাকে নিজের জ্যোতির দিকে পথ দেখিয়ে থাকেন। মানুষের বুঝবার সুবিধার জন্য আল্লাহ উপমা ও রূপক ব্যবহার করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ।’
পাঠক! অনুগ্রহ করে আমীর আলীকৃত উদ্ধৃতাংশে মনোযোগ দিন—দেখুন কী অসম্ভব অর্থালংকারে অনুচ্ছেদটি পূর্ণ। মনে হবে, মনে রাখতে হবে, রূপক-উপমা-উেপ্রক্ষা-সমাসোক্তি ইত্যাদি অর্থালংকার চিত্ররূপময়। শব্দালংকারে রয়েছে শব্দের সংগীতধর্ম—গদ্যকে দিয়ে গান গাওয়াতে হলেও লেখকের শব্দের সংগীতধর্ম বোঝা চাই। কান না থাকলে ভালো গদ্য লেখা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ নিজের গদ্য রচনার পর নিজেই উচ্চারণ করে শুনতেন, বুঝে নিতেন সুর কি না!
আমাদের আলোচনার বিষয় উপমা (যা অর্থালংকারের প্রধান শক্তি বা উপাদান কিংবা শব্দগত ব্যক্তিত্ব) এই উপমাকে কবি ও বিজ্ঞানী কী চোখে দেখেন, সেটারই খানিকটা আলোচনা এখানে আমরা রাখব। বেণিমুক্তির মতো এলায়িত করে মেয়েদের কেতায় গা ঝাড়া দেব; বাহু আন্দোলিত করার ঝটকায়। পুনরুক্তিসহ ব্যাখ্যান করলে কথাটা দাঁড়ায় এই যে, বেণি বাঁধাটা শিল্প, খোলাটাও শিল্পের বিন্যাসকে ভেঙে ফেলার উলটা কেয়ারি। ফাঁস খোলা, তারপর চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চুলের দামে আঙুল চালানো, ঝটকা দিয়ে মাথা নাড়া এবং ঘনঘন বাহুর আন্দোলন—সবই হয়ে ছন্দিতা। ছন্দে ভাঙাটাও তো শিল্প—সবই ঘটছে ছবির মতো করে, তাই আমরা উপমা দিয়ে বললাম, বেণিমুক্তির মতো মেয়েদের কেতায়; এখানে ‘কেতা’ শব্দটিও মতো শব্দের সমবাচক। এত কথা বলার মোদ্দা কথাটি হলো উপমা আমাদের চোখের সামনে ভাবকে অবধি গোচর করায়—প্রতিভাত করায়, বলার কথা সুস্পষ্ট করে তোলে। এবার বৈজ্ঞানিকের কথার আসা যাক।
বৈজ্ঞানিককে পর্যবেক্ষণ পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ দিতে হয় যে, বস্তুর ভেতরের নিয়ম বা কোনো ঘটনার স্বরূপ এমত প্রকার—প্রমাণ না দিলে বিজ্ঞানীর চলে না। কিন্তু কবি কী করেন?
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু লিখেছেন, “বৈজ্ঞানিক ও কবি, উভয়েরই অনুভূতি অনর্বচনীয়। প্রভেদ এই, কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপেক্ষা করেন না। কবিকে সর্বদা আত্মহারা হইতে হয়। আত্মসংবরণ করা তাঁহার পক্ষে অসাধ্য। কিন্তু কবির কবিত্ব নিজের আবেগের মধ্য হইতে তো প্রমাণ বাহির করিতে পারেন না। এজন্য তাহাকে উপমার ভাষা ব্যবহার করিতে হয়। সকল কথায় তাঁহাকে ‘যেন’ যোগ করিয়া দিতে হয়।”
এই ‘যেন’ শব্দটি তুলনাবাচক বা উপমাসূচক।
ভাষাবিজ্ঞানী ভাষার সঙ্গে চোখের তুলনা করেছেন—সেই উপমায় উপমেয় ও উপমানের তুলনার অন্তর্গত এই দুইয়ের সাধারণ ধর্মের কথাগুলো অতীব বিস্ময়ের সঙ্গে একাকার। ভাষাবিজ্ঞানী বা ভাষা-দার্শনিক হ্বিটগেনস্টাইন কতকটা আইনস্টানের কেতায় এই তুলনা করেছেন। আমরা নিজেদের মতো করে ব্যাপারটা তুলে ধরছি। চোখ কী? চোখ হলো তাই, যার সাহায্যে আমরা সবকিছু দেখি বা চোখ আমাদের সবকিছু দেখায়। কিন্তু অবাক কাণ্ড! চোখ নিজেকে দেখতে পায় না। (আয়নায় দেখা বা অন্যের চোখে দেখা ধরলে চলবে না) তেমনিই ঘটে ভাষার বেলাতেও। ভাষার সাহায্যে আমরা সবকিছু ব্যক্ত করি; ভাষা এত বলছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভাষা নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলছে না; বা নিজের সত্তা বিষয়ে কোনো বিবরণ দিচ্ছে না।
আপাতত শুধু বলার, উপমায় যে-জন বিস্মিত হতে জানে না, তার সাহিত্য-বিজ্ঞান বা দর্শন কোনো জগতেই ঠাঁই না থাকাই জরুরি।